৬ দফা

You might also like

Download as docx, pdf, or txt
Download as docx, pdf, or txt
You are on page 1of 7

স্মরণ করছি ৭ জুনের ৬ দফা দিবসকে

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী


 প্র কাশিত ১২:২১ রাত জুন ৭, ২০২০

১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে লড়াইয়ে গো-হারার পর ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে আয়ূব খান
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে এক গোল-টেবিল বৈঠকে আহ্বান জানায়
সেদিন ছিল ৭ জুন, ১৯৬৬। ১৯৬৬ সালের ১৫৮তম দিন মঙ্গলবার। আজ থেকে ৫৪ বছর
আগের ঘটনা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, ফজলুল হক মুসলিম হলের
বাসিন্দা এবং হল সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। গুগল ও উইকিপিডিয়া ঘেঁটে ওই বিশেষ দিনে
বাংলাদেশে কী ঘটেছিল তার বিন্দুমাত্র নিশানা পাইনি। অথচ বাঙালি জাতির ইতিহাসে তা
ছিল এক দিক পরিবর্ত নের লগ্ন। অন্তত, আমরা ক’জন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত ও শপথ নিয়েছিলাম। সেদিনের অনেকেই বেঁচে
নাই। বেঁচে নাই আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, এনতাজ আলী, লুৎফু ল হাই সাচ্চু ,
মজহারুল হক বাকি, আবদুল কু দ্দুস মাখন। বেঁচে আছেন আল আমিন চৌধুরী, তোফায়েল
আহমদ, সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকী, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আহমেদ
জামিল ইব্রাহিম, খালেক, মনির, শেখ সেলিম আর আবদুল মান্নান চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তখন
জেলে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখ থেকে তিনি জেলে। তার অপরাধ তিনি পূর্ণাঙ্গ
স্বায়ত্বশাসনের জন্য ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন, যা চার মাস সময়ের মধ্যে অভূ তপূর্ব
জনপ্রিয়তা অর্জ ন করেছিল।
তার প্রস্তাবিত ৬ দফার দাবীগুলো ছিল নিম্মরূপ
লাহোরে সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিভাবে শেখ মুজিবুর
রহমান ছয় দফা পেশ করেন।
প্রস্তাব-১ শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি
১. দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমন হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি
ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি
পদ্ধতির। সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট হবে সার্বভৌম।
প্রস্তাব-২ শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দু’টি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে, যথা দেশরক্ষা ও
বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কু শ।
প্রস্তাব-৩ মুদ্রা বা অর্থ সম্পর্কীয় ক্ষমতা
ক. সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।

খ. সমগ্র দেশের জন্য কেবল একটি মুদ্রা চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র ব্যবস্থা
থাকতে হবে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে
পূর্ব পাকিস্তান পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভে র ব্যবস্থা করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য
আর্থিক বা অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্ত ন করতে হবে।
প্রস্তাব-৪ রাজস্ব, করা বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৪. ফেডারেশনের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য
অঙ্গরাষ্ট্রের রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সকল করের
শতকরা একই হারে আদায়কৃ ত অংশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব-৫ বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
৫. ক. ফেডারেশনভু ক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহিঃবাণিজ্যকে পৃথক হিসাব করতে হবে।

খ. বহিঃবাণিজ্যির মাধ্যমে অর্জি ত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাষ্টগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে।


গ. কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে
অঙ্গরাষ্ট্র মিটাবে।

ঘ. অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন বাধা-
নিষেধ থাকবে না।

ঙ. শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে
বাণিজ্যিক চু ক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব-৬ আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা
৬. আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্র অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃ ত্বাধীনে
আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

স্পষ্টতঃ ৬ দফা দেওয়া হয়েছিল পূর্ব ও পাকিস্তানের মধ্যে সামগ্রিক বৈষম্য নিরসনের জন্য যা
ছিল আমাদের ম্যাগনা কার্টা, বঙ্গবন্ধু র ভাষায়-আমাদের বাঁচার দাবী। এই দাবীগুলো নিয়ে তিনি
মাঝে মাঝে নিকটজনের কাছে আলাপ করলেও স্বাধীনতার প্রশ্নটি আকারে ইঙ্গিতে বা
অসম্পূর্ণ বাক্যে যেমন “সেতু দিলাম” এর মধ্যে ফু টে উঠত। সেই সেতু ধরেই দেশ এগিয়ে
গেল, জাতি এগিয়ে গেল। কারাবন্দি শেখ মুজিবের নির্দে শেই ৭ জুনকে ছয় দফা দিবস হিসেবে
পালনের সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে
এল আওয়ামী লীগ, যুবনেতা ও ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের সহযোগী হিসাবে শিল্প ও সাহিত্য
সংঘ ক্রিয়াশীল ছিল। নির্যাতনে অতিষ্ঠ ছাত্রলীগ বা ছয় দফার সৈনিকদের বিকল্প সংগঠন
ছিল এই শিল্প ও সাহিত্য সংঘ। একাধিক গোপন সংগঠন ক্রিয়াশীল ছিল। যার মধ্যে ছিল
অপূর্ব সংসদ কিংবা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। আর ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট-যার
জন্ম হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে ১৯৬১ সালে। ১৯৬১ সালেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার চূ ড়ান্ত
সিদ্ধান্ত নিয়ে তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন এক লিফলেটের মাধ্যমে। এই লিফলেট তিনি নিজেই
ইংরেজীতে প্রনয়ণ করেন; নিজেই প্রেসে গিয়ে মুদ্রিত করে ছাত্রলীগের তদানিন্তন সভাপতি
শাহ মোয়াজ্জেমকে দিয়ে দূতাবাসগুলোতে বিতরণের ব্যবস্থা নেন। সামরিক শাসনের মধ্যে
দূতাবাসের গেইটে লিফলেট ছোড়ার মত দুঃসাহসিক কাজটির সাথে শেখ মনি জড়িত
থাকলেও সিরাজুল আলম খান ও আরো অনেকে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে বিতরণ
করেন। জেলা শহরে বিতরনকারিদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তারা হলেন আবদুল মান্নান
চৌধুরী, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ।
ইংরেজীতে লেখা এই লিফলেট এর ভাষ্য নিয়ে আমার পরিস্কার ধারনা ছিল না। পরিস্কার
ধারণা হলো ৭ জুন ১৯৬৬ সালকে ঘিরে। ১৯৬১ সালে এই কাজের অভিযাত্রী শাহ
মোয়াজ্জেম হোসেন এই ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাহসিক কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করলে
সংগঠনের নাম ও দায়িত্বে পরিবর্ত ন আনেন শেখ মুজিব। সংগঠনের নাম বদলিয়ে রাখা হয়
বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) সাবেক নাম ছিল ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট
(ইবিএলএফ)। বিএলএফ এর এক ব্যাপক ও সফল প্রয়াস হলো ৭ জুনের দেশব্যাপী
হরতাল। আগেই বলেছি কারাবন্দি শেখ মুজিবের নির্দে শে সেদিনের হরতালে সারা দেশ
কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সশস্ত্র অভ্যূত্থ্যানের আবহ সৃষ্টি করেছিল। সে পর্যায়ে আসার
আগে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা বাঞ্ছনীয়।

উইকিপিডিয়ার বর্ণনায় আছে যে স্বামী স্ত্রী রবাট ও জোয়ান ওয়ালিক ৭ জুন উড়োজাহাজে
করে ৫দিন ৬ ঘণ্টা, ১৬ মিনিট ও ৪০ সেকেন্ডে বিশ্ব পরিক্রমা সমাপ্ত করেন। আরও কিছু
বিবৃত আছে যা ইতিহাসে এত গুরুত্ব বহনকারি নয়। অতি গুরুত্ববাহি ঘটনাটি যথা ৭ জুনের
হরতাল ইতিহাসে অনুল্লেখ রয়ে গেল বলেই অন্তত নতু ন প্রজন্মের জন্য আমাকে আজকে
কলম ধরতে হলো। তাই লিখছি-

১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে লড়াইয়ে গো-হারার পর ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে আয়ূব খান
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে এক গোল-টেবিল বৈঠকে আহ্বান জানায়। শেখ
মুজিবও সে গোল টেবিলে যোগ দেন। সাধারণের অগোচরে তো বটেই, আওয়ামী লীগের বহু
নেতা কর্মীর অগোচরে তিনি এক টু করা কাগজ নিয়ে লাহোরে হাজির হন। এই কাগজে
ঐতিহাসিক ছয় দফা লিপিবদ্ধ ছিল। গোল-টেবিল বৈঠকে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও
স্বায়ত্বশাসনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বাঁধাগ্রস্ত হন। কিন্তু “বঙ্গশার্দু ল” মুজিব সেই লাহোরে
পাকিস্তানীদের নাকের ডগায় পাকিস্তানের মরণ বান ছয় দফা পেশ করেছিলেন। পাকিস্তানীরা
তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু সুকৌশলে তিনি করাচী হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এই
ছয় দফাই পরবর্তীতে “বাঙ্গালী মুক্তি সনদ” বলে বিবেচিত হলো। কাগজে-কলমে কিংবা
আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ছয়টি দফা লিপিবদ্ধ থাকলেও আসলে তা ছিল এক দফা। শেখ মুজিব
ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন ছয় দফা মানে “কবে যাবা, কত দিবা, কবে দিবা।” তিনি দু-হাতের ছয়টি
আঙ্গুলকে দেখিয়ে পাঁচ আঙ্গুল বিশিষ্ট হাতটি সরিয়ে বলতেন- এ হোল এক দফা (অর্থাৎ
স্বাধীনতা)।

আমাদের অনেক নেতা তা বুঝতে ভু ল করলেও পাকিস্তানের আয়ুব খান, তার সুবেদার
মোনেম খান, খান আব্দুল কাইউম, মওদুদী, ভু ট্রো বা গোলামের যমদের তা বুঝতে বাকি রইল
না বলেই তারা আইয়ুব খানের মতোই কথা বলতে শুরু করে। ছয় দফার জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত
আইয়ুবের সুবেদার মোনেম খান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও
ছাত্রলীগের উপরে নির্যাতন চালাতে শুরু করে। নির্যাতনের মাত্রা ও ছয় দফার জনপ্রিয়তার
মাঝে একটি ধনাত্মকসহ সম্পর্ক ও লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র
মোজাফফর ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) ছাড়া অন্য কেউ এই ছয় দফাকে আমল
দেয়নি। পক্ষান্তরে আয়ূব-মোনেমের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে স্থানীয় নেতাদের অনেকেই ছয় দফা সি-
আই’এর ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। এই আন্দোলনকে দুর্বল কিংবা বিনষ্ঠ করতে তারা
“মাছ তাড়ু য়ার” ভু মিকা নেয় এবং কোনো প্রকার প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছাড়াই
“আসসালামু আলাইমুমের’ পর “স্বাধীন জন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা”, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান বা
যুক্ত বাংলা আন্দোলনের কথা সম্বলিত কিছু বক্তব্য ও লিফলেট বাজারে ছেড়ে দেয়। অব্যাহত
নির্যাতন ও প্রতিরোধের মুখেও শেখ মুজিব ছয় দফার দাবী নিয়ে চারণের মত বাংলার একপ্রান্ত
থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়াতে থাকেন। তাকে হয়রানি ও অবদমিত করার জন্যে মামলার
পর মামলা, কাঠগড়ার পর কাঠগড়ায় ঠেলে দিয়ে শাসককু ল ক্ষান্ত হয়নি। শেষে তাকে
স্থায়ীভাবেই কারান্তরালে ঠেলে দেওয়া হয়। জনগণের নাড়ির স্পন্দন ও সম্পৃক্ততার মাত্রা
যাচাইয়ের জন্যে এবং আন্দোলন তীব্রতর করে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রত্যয়ে শেখ মুজিব
কারান্তরালে বসেই ৭ই জুন সারা বাংলায় হরতাল পালনের নির্দে শ দেন। বঙ্গবন্ধু র অবর্ত মানে
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের প্রাক্তন ও সমকালীন নেতারা ৭ই জুন সারা বাংলাকে স্তন্ধ ও
অচল করে দেয়।

সে দিন পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙ্গালী শহীদ হন, শত শত নেতা-কর্মী আহত ও


কারান্তরালে নীত হন। এই আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের সৈনিক যারা ছিলেন তারা হলেন শেখ
ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, মনিরুল
হক চৌধুরী, আবদুল মান্নান চৌধুরী, আল-আমীন চৌধুরী, ফেরদৌস কোরেশী ও তোফায়েল
আহমদ প্রমুখ। সেদিন মোনায়েমের পেটোয়া বাহিনী আমাদের উপর অস্ত্র ব্যবহার করে; ভাগ্য
গুনে সেদিন আমার মাথার খুলি উড়ে যায়নি। আবদুর রাজ্জাক আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে
ফেলে দেওয়াতে সে বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে আজও বেঁচে আছি। সেদিনই আমরা সশস্ত্র
যুদ্ধের চু ড়ান্ত শপথ নেই। তাকে সফল করার জন্যে বিএলএফকে আরও দৃঢ় ভিত্তিতে গড়ার
পদক্ষেপ নেই।

আগেই বলেছি ১৯৬৬ সালের ৭ই জুনেই আমরা অন্তত নিশ্চিত হয়ে যাই যে নিয়মতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় আমাদের অধিকার অর্জ ন অসম্ভব এবং বিকল্প পন্থা হচ্ছে “অস্ত্রের জবাব অস্ত্রে”।
সেদিন সঙ্গত কারণে আমি অতি মাত্রায় ক্ষিপ্ত ছিলাম। তবে এটাও আমাদের ধারণা ছিল যে
শানিত চেতনা ছাড়া তু লনামূলকভাবে শান্তি প্রিয় ও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “ভেতো বাঙালি”কে
দিয়ে অস্ত্র ধরানো যাবে না; তারা অস্ত্র ধরতে পারবে না; আর অস্ত্র ধরিয়ে দিলেও তা হবে
সন্ত্রাসীর অস্ত্র, বিপ্লবীর অস্ত্র নয়। তাই অস্ত্রের কথাটা মনে গেঁথে নিলেও বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় চেতনা শানিত করতে শুরু করেন। বৃহত্তর জন-গোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত,
বিশ্বজনমত গঠন এবং অভ্যন্তরীণ বৈরী পরিবেশকে পরাভব করার প্রয়াসে ছয় দফা
আন্দোলনকে তু ঙ্গে তোলা হয়। অস্ত্রভিত্তিক সংগঠন গঠন প্রক্রিয়া তাই কারো চোখে এমনকি
পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখেও পড়েনি, তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানিরা তার
কিয়দাংশ উদঘাটনে ব্রতী হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টার সাথে বিএলএফ এর শুধু পরোক্ষ সংযোগ
ছিল, যদিও উদ্যোগের মধ্যমনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু ।

ছয় দফা কর্মসূচীর সাথে সাথে পাকিস্তানের জুলুম-নির্যাতন এবং অপমানকর উক্তিও বাড়তে
থাকে। আয়ূব খান তো এক পর্যায়ে “বাঙালী মুসলমানদের হিন্দুর জারজ” বলে বসল।
ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ল। মুষ্টিমেয় রাজনীতিবিদ ছাড়া সারা দেশের বুদ্ধি বিবেকবান
মানুষকে এই জাতীয় কথা ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত করে তু লল। ছয় দফাকে সমূলে নির্মূল করতে
আয়ূব-মোনায়েম শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি করে একটি
রাষ্ট্রদ্রোহীতা মামলা রুজু করে। তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রধান হোতা বলে চিহ্নিত
করা হয়। শেখ মুজিব জেলে থাকাবস্থায়ই ছাত্র সমাজ তোফায়েল আহমদের নেতৃ ত্বে ১১ দফা
আন্দোলন শুরু করে। ১১ দফার তিন দফায় ক, খ, গ, ঘ, ও চ ক্রমধারায় হুবহু বঙ্গবন্ধু র ছয়
দফাকে সন্নিবেশিত করা হয়। এই আন্দোলনের তোড়-জোড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তু লে
নিতে সরকার বাধ্য হয়। তবে ১৯৬৯ সালের আন্দোলনেরকালে রাজপথে আমরা এমন সব
শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তু লি যা আমাদের আসল মতলব ও সশস্ত্র যুদ্ধের স্পষ্ট ইংগিত বহন
করে। এই সময়ের কতিপয় শ্লোগান হলো (১) তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা (২)
পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা (৩) তু মি কে আমি কে ? বাঙালী বাঙালী (৪) জিন্না মিয়ার
পাকিস্তান আজিম পুরের গোরস্তান, কৃ ষক-শ্রমিক অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি।
শোষণ-বঞ্চনার চিত্রটি এ সময়ে সাধারণ পর্যায়েও পরিব্যপ্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের
সার্বজনীন আন্দোলনই এটাকে আরও সামনে এগিয়ে দেয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমারা "নৌকায় ভোট দিন, স্বাধীনতার শপথ নিন" জাতীয়
শ্লোগান চালু করে দেই। এল, এফ,ও, থাকা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগ তার ৬ দফাকে নির্বাচনী
ম্যানিফেষ্টোতে অন্তর্ভু ক্ত করে, ভাসানী ন্যাপ ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ বলে নির্বাচন বর্জ ন
করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূ ত হন
এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ৬ দফা কায়েমের ম্যান্ডেট পেয়ে যান। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু স্বল্প
রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে কিংবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন। আওয়ামী
স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীকে আধা সামরিক বাহিনীতে রূপান্তর করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
থাকাবস্থায় স্বল্প রক্তপাতে কেন্দ্র থেকে বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তাও তার মনে দোলা দেয়। এ
ব্যাপারে মনে হয় তিনি কোন একটি বৃহৎ শক্তির মধ্যস্থতা কামনা করেছিলেন। শেষমেশ অস্ত্র
ধরেই দেশকে শত্রুমুক্ত করা হয়, যার আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর উপাচার্য। ১৯৬৬
সালের ছয় দফা দিবসের অগ্র-গামী সৈনিক।
BBC Bangla writes:
মুজিব জন্মশতবার্ষিকী: ষাটের দশকে শেখ মুজিবের রাজনীতি, ছয় দফা ও অন্যান্য
১৩ মার্চ ২০২০
১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর থেকে বাঙালির অধিকার আদায়ের
সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু।

এই পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান সুনির্দি ষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য আর
শোষণের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে।

এর প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি, যাকে বলা হয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রুপরেখা।

You might also like