Professional Documents
Culture Documents
অধ্যবসায়
অধ্যবসায়
ভূ মিকা :
জীবনের সঙ্গে সময়, কর্ম এবং কর্মের সঙ্গে অধ্যবসায়- এ যেন একই সুতোয় গাঁথা মালা। একটি বাদ পড়লে
অপরটিতেও টান পড়ে। প্রত্যেক মানবজীবনে এক কর্মযজ্ঞ নিরন্তর চলমান, আর এই কর্মযজ্ঞে সাফল্য ব্যর্থতা
দুইই যেন “চক্রবৎ পরিবর্ত ন্তে”। তবু মানুষ সর্বদা সাফল্যের প্রতিই ধাবমান হয়, আর অধ্যবসায় হল যেন এই
অধ্যবসায় ছাড়া মানবজীবনে সাফল্য এক দিবাস্বপ্ন মাত্র। অধ্যবসায় তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে এক অবশ্য
পালনীয় অভ্যাস যা তাকে পরিবর্তে সাফল্য এনে দেয়। এযাবৎকালের যত সফল মানুষের উদাহরণ আমরা দেখতে
মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে তার জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর, তার ইচ্ছে মত জীবন চালানোর, সকলেই চায়
সফলতার মুখ দেখতে- কিন্তু জীবনের পথ কু সুমাস্তীর্ণ নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। মানুষ তার জীবৎকালে যেসমস্ত
কাজ সমাধা করতে চায়, সেই সব কাজেই সহজে সাফল্য পাওয়া যায়না। অনেক কাজেই সাফল্য একবারে
আসেনা।
বরং বারংবার চেষ্টা আর নিরলস পরিশ্রমই সাফল্য এনে দিতে পারে সেসব ক্ষেত্রে। একবারের চেষ্টায় সাফল্য না
এলে তাই হতাশ হতোদ্যম হলে কাজে সাফল্য পাওয়া দুরাশা মনে হতে পারে। সাফল্য লাভের আশায় বুক বেঁধে
বারবার এই প্রয়াস করে যাওয়াই আদতে অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ের এমন দুরূহ ধারণাকেই কবি প্রচলিত প্রবাদ এর
তু মি ও পারিবে তাহা,
কোন কাজে সাফল্য পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ধৈর্য ও সহিষ্ণু তার মাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাওয়ার নামই
অধ্যবসায়। এই অধ্যবসায় আসলে কয়েকটি বিশেষ গুণের সমাহার। চেষ্টা, উদ্যোগ, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ধৈর্য ও
হতাশ না হওয়া- এই সকল গুণের একত্র সাধন এর মধ্যে দিয়েই মানুষের অধ্যাবসায় সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে।
শুধুমাত্র ভাগ্যের দিকে চেয়ে না থেকে, পরিশ্রম এবং ধৈর্য কে অবলম্বন করে নিজের মনের আপন বিশ্বাস ও
স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপদানের আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে অধ্যাবসায়ের সার্থকতার মূল বাণী।
অধ্য বসায়ে র গুরুত্ব :
মানবসভ্যতার বর্ত মান যে উন্নয়ন, তার মূলে অধ্যবসায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূ মিকা আছে। আদিম গুহাজীবন থেকে
আজকের সভ্য নগরজীবনে উঠে আসতে মানবজাতির একমাত্র হাতিয়ার ছিল এই অধ্যবসায়ই। মানবজীবনের
যেকোন কাজে বাধা আসাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই বাধাকে ভয় পেলে কিংবা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে সাফল্য
রাতের অন্ধকার পেরিয়ে যেমন দিনের আলোর প্রকাশ ঘটে, ঠিক তেমনই, বারবার অবিশ্রাম চেষ্টার পরেই মানুষের
ভাগ্যাকাশে উদিত হয় সাফল্যের সূর্য। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়, সে যেকোন অসাধ্য সাধন করতে পারে।
পৃথিবীতে সকল ধর্মগ্রন্থ তথা দার্শনিক আকরগ্রন্থে অধ্যাবসায়কে একটি মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তু লে ধরা
হয়েছে।
মেধা, সুযোগ কিংবা বিশ্বাস, কোনটাই মানুষকে চূ ড়ান্ত সাফল্য এনে দিতে পারবেনা যদি না অধ্যবসায়কেই মুখ্য
করে তোলা যায় এদের যথাযথ প্রয়োগে। নিজেকে একজন সত্যিকার সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে
অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই। অধ্যবসায়ী মানুষই সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারে।
নিরাশা বা ব্যর্থতার গ্লানিকে মুছে নতু ন করে শুরু করার একমাত্র পথ হল অধ্যবসায়ী হওয়া- কেননা, Failure
তাঁরা অকু তোভয় ও নির্ভীক। ত্যাগে ও ধৈর্যে তাঁরা মানুষের কাছে তু লে দিয়েছেন মুক্তির সনদ। হজরত
মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে যে ত্যাগ ও অসাধারণ অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছেন তা
স্মরণীয়। রবার্ট ব্রুশ সামান্য মাকড়সার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে শত্রুর হাত থেকে স্বদেশের স্বাধীনতা
পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জর্জ বার্নার্ড শ প্রথম জীবনের হতাশাকে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জয়
করে বিশ্বখ্যাত লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। মহাকবি ফেরদৌসী দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে রচনা করেছিলেন তাঁর
মহাকাব্য ‘শাহনামা’। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশ ২০ বছরের একক প্রচেষ্টায় রচনা করেন ৫০ হাজারের বেশি
মাত্রাসংবলিত বাংলা ভাষার বিশাল অভিধান। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
ছাড়াই নিজের প্রচেষ্টা ও সাধনায় দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে সংগ্রহ করেছিলেন দুই হাজার প্রাচীন পুঁথি,
যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চার শ বছরের ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদ্ঘাটিত হয়।
জীবনসংগ্রামে জয়লাভের মূলমন্ত্র হল অধ্যবসায়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মধ্যযুগীয় ফরাসি সম্রাট
নেপোলিয়ন বোনাপার্টে র কথা। কেবলমাত্র অধ্যাবসায়ের জোরেই নেপোলিয়ান সামান্য এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান
থেকে ফ্রান্সের সম্রাট হতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে আমাদের দেশেও অধ্যাবসায়ের আদর্শকে পাথেয় করে জীবনে
একদিকে শ্রীনিবাস রামানুজন, অন্যদিকে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফু ল্ল চন্দ্র রায়, তথা এপিজে আবদুল কালাম- এরা
সকলেই কেবলমাত্র অধ্যাবসায়ের আদর্শকে সামনে রেখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের জীবনে সফল হয়
সমগ্র বিশ্বের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অধ্যবসায়ের আদর্শ ব্যতীত জীবনে সাফল্য আসা এক প্রকার
সাফল্যের শিখরে। আদর্শের মাধ্যমে সাফল্য অর্জ ন করার পথ দীর্ঘ হতে পারে, কঠিন হতে পারে; কিন্তু সেই পথে
নিরলস প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার একমাত্র উপায় হলো নিজের ওপর
পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখা। অধ্যবসায়ের আদর্শকে সামনে রেখে আপন ব্যক্তিত্বের দাঁড়া ধৈর্যশীল হয়ে লক্ষ্যের
অধ্যাবসায় জীবনের যে পর্যায়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো মানুষের ছাত্র জীবন। ছাত্রজীবনে
অধ্যাবসায় ব্যতীত কোন ব্যক্তির জীবন গড়ে উঠতে পারে না। তাই বলা যায় ছাত্র জীবন এবং অধ্যাবসায় এই দুটি
পড়ে, অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে পরবর্তীর জন্য তৈরি করাই হল আদর্শ ছাত্রের কাজ। জীবনের অন্যান্য
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ব্যক্তিই নিজের ভেতর কোনো না কোনো
প্রতিভা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। যারা মনে করে তাদের কোনো প্রতিভা নেই, আদপে তারা অধ্যাবসায়হীনতার
কারণে নিজেদের সেই সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কেউ যদি নিজেকে প্রতিভাহীন মনে করে হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে হতাশার গ্লানি তাকে আচ্ছন্ন করে।
স্বাভাবিকভাবেই আসে ব্যর্থতা। প্রকৃ তপক্ষে জীবনে প্রতিভার থেকেও যে গুণটির গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি, তা হলো
অধ্যাবসায়। বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক স্যার আইজ্যাক নিউটনও তার জীবনে প্রতিভার থেকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন
অধ্যাবসায়কে।
তার মতে শুধুমাত্র পরিশ্রম, ধৈর্য এবং অভ্যাসের মাধ্যমেই সাফল্যের শিখরে আহরণ করা যায়। তার জন্য আলাদা
করে বিশেষ কোনো প্রতিভার দরকার হয় না। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার মনে করতেন, প্রতিভা বলে প্রকৃ তপক্ষে
প্রতিভা ও মেধা ছাড়া কোনো কঠিন কাজে সফলতা আসে না বলে অনেকের বিশ্বাস; কিন্তু নিরলস
পরিশ্রম ও অধ্যবসায় না থাকলে শুধু প্রতিভা দ্বারা কোনো কাজে সাফল্য অর্জ ন করা যায় না। বস্তুত
মানবজীবনের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। এতদ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী
নিউটন বলেছেন, ‘আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে
বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলো আমি ধরতে পেরেছি।’ এ বক্তব্যেরই অনুরণন লক্ষ করা যায় দার্শনিক
ভলতেয়ারের উচ্চারণে—‘প্রতিভা বলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে
অগ্রাহ্য করতে পারবে।’ বিজ্ঞানী ডাল্টনও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছেন—‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে সাথে জাতীয় জীবনেও অধ্যবসায়ের এক বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত মনে রাখা
দরকার ব্যক্তিমানুষকে নিয়েই একটি জাতি গড়ে ওঠে। তাই কোন জাতির ব্যক্তি মানুষগণের গড় চারিত্রিক গুণই
সেই জাতির সামগ্রিক চরিত্রে প্রতিফলিত হয়। এ কারণে কোন ব্যক্তি যখন অধ্যাবসায়ী হয়, সে তার নিজের সাথে
এইভাবে কোন জাতির ব্যক্তি সমষ্টি যখন অধ্যাবসায়ী হয়ে ওঠে তখন সেই জাতির সামগ্রিক চরিত্রই হয়ে ওঠে
ধৈর্যশীল এবং অধ্যাবসায়ী। তাছাড়া একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন সেই জাতির প্রতিটি
মানুষ অনন্ত অধ্যাবসায়কে পাথেয় করে সেই জাতির উন্নতির ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করবে। সেজন্য কোনোদিক
উন্নত বিশ্ব কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর কর্মের সঙ্গে অধ্যবসায়ের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক । অধ্যবসায়ের
মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ আরো কয়েকটি দেশ সাফল্যের শিখরে
আরোহণ করেছে।
এ কথা গর্বের সঙ্গে বলা যায় যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চরম অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়ে বাঙালি জাতি
তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
অধ্য বসায়হীনতার কু ফল :
অধ্যবসায়হীনতার সমার্থক শব্দ হলো ‘আলস্য’। আলস্য মানবজীবনে ডেকে আনে বিপর্যয় ও ধ্বংস।
অধ্যবসায়হীনতার কারণে আমাদের চারপাশের অনেক সম্ভাবনাময় জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কথা স্মরণীয়
যে ‘সুন্দর দিন সকলের জন্য অপেক্ষা করে; কেউ চেষ্টা করে ডেকে আনে, কেউ আনে না’—এই আনা-না
আনার সঙ্গেই অধ্যবসায়ের সম্পর্ক ।
উপসংহার :
অধ্যবসায়ী ব্যক্তির জীবনের মূলমন্ত্র হল- ব্যর্থতাই সাফল্যের সোপান। নিজের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের এবং
জাতির সামগ্রিক উন্নতিসাধন সম্ভব- একথা প্রমাণিত সত্য। “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন”- অধ্যবসায়
সম্পর্কে এটি একটি চরম সত্য প্রবাদ। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয়, সে জীবনের সাধারণ কোন কাজেও সফলতা
পায়না।
জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা এই অধ্যবসায়ের উপরেই নির্ভ র করে, তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিৎ অধ্যবসায়ের মত
মহৎ গুণটিকে আয়ত্ত্ব করা। অধ্যবসায় আমাদের জীবনে পরশপাথরের মতো কাজ করতে পারে। যদি আমরা
তাকে আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তবে তার ছোঁয়ায় আমাদের যেকোন কাজেই স্বর্ণসফলতা আসতে
বাধ্য।