Download as docx, pdf, or txt
Download as docx, pdf, or txt
You are on page 1of 17

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও
সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্থানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করে যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে
পরিচিত। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং  মামলা। ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা শহরে ভারতীয় পক্ষ ও
আসামি পক্ষদের মধ্যে এ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে মামলায় উল্লেখ থাকায় একে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়।
= ৬ জানুয়ারী, ১৯৬৮ সালে দুই জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের গ্রেফতার সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে দাবী
করা হয়েছিল গত মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে এক চক্রান্ত উদ্ঘাটন
করেছে। ১৮ই জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার করে তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর
নিরাপত্তায় বন্দি করে রাখে।
= এ মামলায় অভিযুক্ত যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জ শীট দাখিল করা হয় তারা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন,
স্টু য়ার্ড মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট
সার্জে ন্ট মাহফিজউল্লাহ, প্রাক্তন কর্পোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কু দ্দুস
সিএসপি, ফ্লাইট সার্জে ন্ট মো. ফজলুল হক, ভূ পতিভু ষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃ ষ্ণ সেন, সুবেদার আব দুর রাজ্জাক, প্রাক্তন
হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন ফ্লাইট সার্জে ন্ট মো. আবদুর রাজ্জাক, সার্জে ন্ট জহুরুল হক, মো. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর
রহমান সিএসপি, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফু জুল বারী, সার্জে ন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম এএমসি, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল
মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এ.এন.এম নুরুজ্জামান, সার্জে ন্ট আবদুল
জলিল, মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লে. এস.এম.এম রহমান, প্রাক্তন সুবেদার এ.কে.এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন
খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এএমসি এবং লে. আবদুর রউফ।

বিচার প্রক্রিয়া

‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ শেখ মুজিবুর রহমান, সার্জে ন্ট জহুরুল হক-সহ অন্যান্য আসামীকে গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল

থেকে কু র্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। মামলার বিচারের জন্য ফৌজদারি দন্ডবিধি সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১-ক ধারা এবং ১৩১ ধারায় মামলার শুনানি শুরু হয়। মামলার

স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘সিগন্যাল অফিসার মেসে’  নির্ধারণ করা হয়। মামলাটির শেষ তারিখ ছিল ৬ই

ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে।


অভিযোগনামা

‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার’ শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে,

অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে
চেয়েছিল।
ফলাফলঃ
গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং
শেখ মুজিবসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বতস্ফূ র্ত অংশগ্রহণে ১৯৬৯ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংঘটিত হয়।
ইতিহাসে এটি উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত।
* জেনারেল আইয়ুব খানের পতনের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন একত্রিত হয়ে
একটি সর্বদলীয় ‘ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা আওয়ামী লীগের ছয় দফা সম্মিলিত দাবী
আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। সরকার এ আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতন শুরু করে।
* পাকিস্তানি সামরিক শাসন উত্খাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এ দিনে সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন ভঙ্গ
করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকু মার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। আর ২০ জানুয়ারী ঢাকার
ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম
নেতা আসাদউজ্জামানের (আসাদ) আত্মদানের পর ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক পালনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে
গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়।
*  ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সার্জে ন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় ঢাকার কু র্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে গুলিতে নিহত
হন। তাঁর ম ৃত্যু সংবাদে পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে যে, বিকেলে মওলানা ভাসানী লক্ষাধিক লোকের জনসভায় দুমাসের মধ্যে ১১
দফার বাস্তবায়ন এবং সকল রাজবন্দির মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রয়োজন
হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙ্গে শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে আনা হবে। সভাশেষে জনতা মন্ত্রীদের গ ৃহে অগ্নিসংযোগ শুরু করে।
* ১৮ ফেব্রুয়ারী সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। তিনি বিক্ষোভকারী ছাত্রদের
শান্ত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই খবরে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে।
* এই আন্দোলন বিপ্লবাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে। সকল গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে
যুক্ত হয়।
* সামরিক সরকার ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিতে
বাধ্য হয়।
* ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্ত মান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া
হয়। সেখানে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তদানীন্তন ডাকসুর ভিপি ছাত্রনেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
* আন্দোলনের তীব্রতায় ভীত হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ সালে জেনারেল আইয়ুব খান
তার সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান- এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে বাংলা ভাষা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ ছিল বাংলা ভাষা ভাষি। আর বাকি ৪৪ ভাগ ছিল উর্দু এবং অন্যান্য
ভাষাভাষী। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাকে উপেক্ষা করতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জনাব তামাদ্দুক
হোসেনের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান যুব কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও
আইন আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর পর
বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবি জানিয়ে এগিয়ে আসে তমদ্দুন মজলিশ। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা
আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু প্রকাশ করে। এই পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন ১)
অধ্যাপক কাশেম ২) ড. কাজী মোতাহের হোসেন এবং ৩) জনাব আবুল মনসুর আহমদ। তারা বাংলা ভাষার পক্ষে
যুক্তি প্রদর্শন করে উর্দু র সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র্র ভাষা করার দাবি জানান এবং ভাষা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি
করেন। ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস (অক্টোবর মাসে) ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিকভাবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র
ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জনাব নুরুল হক ভূঁ ইয়া।
১৯৪৭ সালে করাচিতে (ডিসেম্বর মাসে) পাকিস্তান সরকারের এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দু কে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে
এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সৈয়দ আফজাল প্রমুখ মন্ত্রীদের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করে বাংলা ভাষার সমর্থনে তাদের প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়। এই ভাবে ভাষা আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হয়।
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের ভাষার প্রশ্নে দাবি ছিল নিম্নরুপঃ-
ক) বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তানের) শিক্ষার বাহন ও অফিস আদালতের ভাষা।
খ) পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে দু’টি-বাংলা এবং উর্দু ।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের
কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদের সদস্য কু মিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে
গণপরিষদের অন্যতম ভাষা রূপে স্বীকৃ তি প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। কিন্তু গণপরিষদ তার এ
দাবি প্রত্যাখ্যান করায় পূর্ব বাংলায় ছাত্র/শিক্ষক বুদ্ধিজীবী মহলে বিরাট অসন্তোষ দেখা দেয়। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি
ঢাকায় ধর্মঘট পালন করা হয়। ১৯৪৮ সালে ২রা মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক
হলে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সংগঠনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্য ১৯৪৮ সালের
১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঐ দিন ঢাকায় বহু ছাত্র আহত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল
হক ও অলি আহ্ম্মদসহ অনেকে গ্রেফতার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৩ মার্চ
পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট ১৫ মার্চ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশের সকল জেলাতেও পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ১৫ মার্চ আলোচনায় বসেন ও একটি চু ক্তি
স্বাক্ষর করেন। এ চু ক্তিতে আটক ছাত্রদের মুক্তিদান, পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন
পরিষদে উত্থাপন এবং ১৪৪ ধারাসহ সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভূ ক্ত ছিল।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং ২১শে মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে
এক ভাষণ দেন। এ জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দু ই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ২৪শে মার্চ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জ ন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্ত ন অনুষ্ঠানে ও তিনি উর্দু কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে আবার ঘোষণা দেন।
উপস্থিত ছাত্ররা নো নো বলে জিন্নাহর কথার তীব্র প্রতিবাদ জানান। ঐদিনই রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলা
ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কার নামে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে। মাওলানা
আকরাম খাঁ ছিলেন এ কমিটির সভাপতি। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান
ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া একটি মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায়
উত্থাপন করেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি। তাছাড়া, ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান
সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে ঘোষণা করেন যে উর্দু ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
হবে। পূর্ব বাংলার জনগণ এ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রচ- প্রতিবাদ জানায়। ফলে গণপরিষদে ভাষার প্রশ্নে আলোচনা স্থগিত
হয়ে যায়। ১৯৫১ সালে আততায়ীর হাতে লিয়াকত আলী খান মৃত্যুবরণ করলে খাজা নাজিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন উর্দু ই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
খাজা নাজিম উদ্দিনের এ ঘোষণায় পূর্ব বাংলার গণমানসে প্রচ- ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে এর প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপি
ধর্মঘট ও হরতাল পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সেদিনই আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম
মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এ সংগ্রাম কমিটি রাষ্ট্রভাষা দাবি প্রতিষ্ঠা না
হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৪ঠা ফেব্রুয়ারি
ছাত্রধর্মঘট ও ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ও সারাদেশে হরতাল পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে।
এদিকে ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দিমুক্তির দাবিতে
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহ্মেদ আমরণ অনশন শুরু করেন। নূরুল আমিন সরকার ছাত্র
আন্দোলনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ
ঘোষণা করে। কিন্তু ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র/ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা পূর্ব পরিকল্পনা
অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই সেস্নাগান দিতে দিতে প্রাদেশিক পরিষদের দিকে অগ্রসর হয়। ঐ
সময় প্রাদেশিক পরিষদে অধিবেশন চলছিল। অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে ছাত্ররা বর্ত মান ঢাকা মেডিকেল
কলেজের সামনে সমবেত হয়। এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকেও মিছিল বের করে ছাত্র জনতারা
একাত্ম ঘোষণা করে। উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করলে
সংঘর্ষ চরম আকারে বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে
শহীদ হয়। আহত হয় বহু সংখ্যক ছাত্র জনতা। নিমেশের মধ্যে এ হত্যাকা-ের খবর ঢাকা শহরসহ পূর্ব বাংলার আনাচে
কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে ২২ শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশাল মিছিলসহ শোভা যাত্রা বের হয়। বর্বর পাক সরকার
এই শোভা যাত্রায়ও গুলি বর্ষণ করার ফলে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। এই দিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের
ছাত্রাবাসে ছাত্ররা আলোচনা করে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত
মোতাবেক সারারাত কাজ করে ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ১২ ফু ট উঁচু শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এই
অস্থায়ী শহীদ মিনারটি ২৩শে ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউর রহমানের পিতা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ২৪ শে
ফেব্রুয়ারি পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। শহীদদের সেই স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য সেখানে আরেকটি স্থায়ীভাবে শহীদ
মিনার নির্মাণ করা হয় এবং এটাই হলো এখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
পরিশেষে, নুরুল আমিন সরকার বুঝতে পারে যে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃ তি দিতে
হবে। তাই সরকার ছাত্র জনতার আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৫৬ সনের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়।
আমাদের শিক্ষা এবং করণীয় : ভাষা আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। পৃথিবীর মধ্যে কম দেশই
আছে যে জাতি নিজের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা মেনেই আমরা স্বাধিকার
আন্দোলনের শিক্ষা পেয়েছি। এই ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই বাঙালিরা অনেক আন্দোলনে সফলতা লাভ
করেছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তখন বাঙালি জাতি সংহত, ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হয়ে ওঠে যা তাদেরকে
পাকিস্তানি শাসক, শোষকের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সংঘবদ্ধ করে তোলে। ভাষা আন্দোলন হলো বাঙালি জাতির চরম
আত্মত্যাগ, অসীম সাহসিকতা ও পরম প্রাপ্তির ইতিহাস। এর প্রেরণার কোনো শেষ নাই। বলতে গেলে, ভাষা আন্দোলন
হলো বাঙালি জাতির প্রথম মুক্তির সনদ বা আন্দোলন। তাই, বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে
শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে দেশ গড়ার অধিকার ব্যক্ত করেন। সঙ্গে, সঙ্গে বিশ্বব্যাপি
জাতিসংঘের ১৯৪টি সদস্যভু ক্ত রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে যার, যার, মাতৃ ভাষা রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা
দিবস পালন করে থাকে।

You might also like