Download as docx, pdf, or txt
Download as docx, pdf, or txt
You are on page 1of 15

এবারের নির্বাচনের নজরকাড়া জাঁকজমক আর জৌলুসের সম্ভবত এর আগের সমস্ত নজির ভেঙ্গে নতু ন

রেকর্ড স্থাপন করেছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে । আদর্শের লড়াই পরিণত হয়েছে গৎবাঁধা আক্রমণ, কথার

ফু লঝু রি আর খিস্তি খেউড়ে। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। এক সর্বগ্রাসী লোকদেখানো

নাটু কেপানা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রহসনের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অবশ্য তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী মূল দলগুলির

পোয়াবারো। পূর্বেকার কাজের হিসেব বা ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন জবাবদিহির

বালাই নেই। মানুষের প্রাপ্য ও ন্যায্য অধিকার, তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব চাপা পড়ে যায় লক্ষ লক্ষ

ওয়াটের এই হাই-ভোল্টেজ প্রদর্শনীর তলায়।

এরই মধ্যে আমরা দেখেছি অতিমারীর চাপে মানুষের হাহাকার-আর্ত নাদ। এবং মানবিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে

মোদী সরকারের একাধিক নেতিবাচক পদক্ষেপ যার মধ্যে অন্যতম বিষয় হল বিলগ্নিকরণের নামে ব্যাঙ্ক সহ

অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বিক্রিবাট্টা করার পরিকল্পনা। অবশ্য এই স্ট্র্যাটেজিক সেল-এর মূল স্ট্র্যাটেজি হল

কিভাবে দেশের সম্পদগুলো জলের দরে বা প্রয়োজনে বিনামূল্যে বড় বড় শিল্প

। ফলে ভোটের বাজারে বেসরকারিকরণ, বেকারত্ব বা মুদ্রাস্ফীতি বর্ত মানে গৌণ হয়ে গিয়েছে। তাই গত

ফেব্রুয়ারি মাসের বাজেটে যে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ব্যাঙ্ক ট্রেড ইউনিয়নগুলি

এর প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকার ঘটনা গুলো চর্চার অভাবে আমাদের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি থেকে বিস্মৃত হয়ে গেছে।

ফলে আজকে ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে আবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেই সমস্ত বিষয় গুলি নিয়ে আলোচনা

করার, বারবার সাধারণ পাঠকের সামনে তু লে ধরার যাতে ধর্ম-গোহত্যা নয় বরং মানুষের অধিকারের দাবী হয়ে

উঠু ক রাজনীতির একমাত্র বিতর্কে র বিষয়।


ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ইতিহাস দীর্ঘদিনের এবং এই ব্যবস্থার মূল সভত্যার গভীরে অন্তর্নিহিত। ফলত দৃঢ়

রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার এই বিপুল কাঠামোগত পরিবর্ত ন সম্ভব ছিল না। প্রাক্তন আরবিআই

গভর্নর ওয়াই. ভি. রেড্ডি তার বক্তব্যে বলেছিলেন স্বাধীনতার পর ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ যেরকম একটি

রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিলো ঠিক তেমনই ব্যাঙ্কের পুনরায় বেসরকারিকরণ হবে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বেসরকারিকরণের এই গৃহীত পদক্ষেপের পরিসর শুধুই অর্থনৈতিক পরিধির মধ্যে

সীমাবদ্ধ নেই বরং এই সিদ্ধান্ত সামাজিক ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখবে। তবে ব্যাঙ্ক

ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টা আজকে শুরু হয়নি। ১৯৯২ সালের নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক

পরিকল্পনা গ্রহণের সময় থেকে ব্যাঙ্কগুলি কে একে একে বেসরকারিকরণ করা শুরু হয়। নরসিমা রাওয়ের

নেতৃ ত্বাধীন কমিটি সুদের হার, লিকিউডিটি অনুপাত এবং ক্যাশ রিসার্ভ অনুপাতের উপর থেকে সরকারি

হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে ও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি নির্ধারণের জন্য পূর্বের নিয়ম গুলি ছিল সেগুলি

শিথিল করার প্রস্তাব দেয় এবং এই প্রস্তাব অনুযায়ী তৎকালীন সরকার অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মত ব্যাঙ্কিং

ক্ষেত্রকে বেসরকারি বিনিয়োগের সামনে খুলে দেয়। তবে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা কাঠামো পরিবর্ত নের এই সিদ্ধান্ত ব্যাঙ্কের

বিনিয়োগের চরিত্র পাল্টেছে অর্থাৎ পূর্বে যেখানে নির্দি ষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাঙ্ক কে অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র যেমন ক্ষু দ্র

শিল্প বা কৃ ষি ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা ছিল যাতে সাধারণ মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটে এবং গরীব

মানুষ একটি স্থায়ী উপার্জ নের ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু ১৯৯২ সালের পর থেকে এই ক্ষেত্র গুলিতে

বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে শুরু করে পরিবর্তে দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এমন প্রোজেক্টে বিনিয়োগ বাড়তে শুরু

করে। কারণ পূর্বের সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির মুনাফার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটানো ছিল
অন্যতম উদ্দেশ্য কিন্তু নয়াউদারবাদি অর্থনীতি এবং বেসরকারিকরণের ফলে ব্যাঙ্ক গুলির মূল দর্শন হয়ে দাঁড়ায়

মুনাফা। ফলে পূর্বে ব্যাঙ্কের কারণে সাধারণ মানুষের হাতে প্রয়োজনীয় কাঁচা টাকা পৌঁছানোর যে পথ খোলা ছিল

টা বন্ধ হয়ে যায় এবং ঋণের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে শুরু হাতে গোনা কিছু শিল্পপতি। তবে ১৯৯২

সালের পর এই বেসরকারিকরণ শুরু হলেও ২০২১ সালের বাজেটে গৃহীত বেসরকারিকরণের পদক্ষেপের মত

সম্পূর্ণ একধাক্কায় খোলনলচে সম্পূর্ণ বদলে ফেলার এই চেষ্টা ভারতের ইতিহাসে প্রথম। তাই বলা যায় যে

ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে আমুল জনবিরোধী পরিবর্ত ন ঘটানোর প্লট তৈরি করা শুরু হয়েছিল ১৯৯২

সাল থেকে; ২০২১ সালে এসে সেই গল্প ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছায়।

তবে এই পরিবর্ত ন করতে এই দীর্ঘ ২৮ বছর সময় লাগার কারণ কি? এই কারণ খুঁজতে গেলে ভারতের

ইতিহাসে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্তার গুরুত্ব সম্পর্কে আমার ফিরে দেখা দরকার কারণ ভারতের ক্ষেত্রে এই অর্থনৈতিক

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ভিত্তি অন্যান্য বেশিরভাগ দেশের থেকে অনেক বেশি দৃঢ় এবং সমাজের গভীর অবধি

নিজের শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ এবং ৩য় শতাব্দীর সময়ে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম

গুরুত্বপূর্ণ ডকু মেন্ট এবং মধ্যযুগে ভারতের অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থার চরিত্র কেমন ছিল তা সম্পর্কে ধারণা

পাওয়া যায়। কৌটিল্য তার লেখায় একাধিকবার সুদের ব্যবসায়ীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ব্যাঙ্ক

ব্যবস্থার মূলে যে সুদ ব্যবস্থা রয়েছে তার উৎপত্তি ভারতবর্ষে মধ্যযুগেী শুরু হয়েছে। তবে এই ব্যবস্থার কাঠামো

প্রাথমিক সময়ে শক্তিশালী না হলেও ১২’শ শতকের সময়কাল থেকে সারা ভারত জুড়ে ব্যাঙ্কের পত্তন শুরু

হয়। তবে এই সময় কে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে ইউরোপে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা পত্তনের দু’শ -তিন’শ বছর আগেই
ভারত জুড়ে ব্যাঙ্ক তৈরি হতে শুরু করে। যদিও প্রাচ্যের সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম ব্যাঙ্ক

মন্টে দে পাশি (Monte De’ Pashi) তৈরি হয় ইতালি তে ১৪৭২ সালে কিন্তু ভারতের ইতিহাসে তার নিজস্ব

চরিত্র নিয়ে স্থানীয় ব্যাঙ্ক ইতালির তে ব্যাঙ্ক তৈরি হওয়ার প্রায় দুইশত বছর আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। এই

বক্তব্যের সত্যতা অনুধাবন করা যায় ১৯২৬ সালে W.E.Priston এর করা বক্তব্য থেকে। তৎকালীন রয়্যাল

কমিশনের অধীনে থাকা ভারতীয় মুদ্রা এবং ফিনান্স দপ্তরের সদস্য W.E.Priston মন্তব্য করেন ইংল্যান্ডে

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিজ্ঞান সম্পূর্ণ ভাবে আবিস্কারের অনেক থেকেই ভারতে স্থানীয় অর্থনীতির প্রয়োজন মত

একাধিক ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব ছিল। এছাড়াও পলাশীর যুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ সিরাজদৌল্লার রাজত্বকালে

আমরা জগত শেঠের কথা জানতে পারি। কথিত আছে বিপুল সম্পত্তির মালিক জগত শেঠের করায়ত্ত থাকা

সোনা দিয়ে নাকি সমগ্র গঙ্গা কে সোনার পাত দিয়ে মুড়ে ফেলা যেত এবং এই বিপুল সম্পত্তির উৎস ছিল

সুদের ব্যবসা ও কারেন্সি এক্সচেঞ্জ। তবে এই জগত শেঠ নিতান্তই একজন ব্যবসায়ী সাধারণ ছিলোনা বরং তার

প্রভাব রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সিরাজদৌল্লার পলাশীর যুদ্ধে হারের পেছনে জগত শেঠের

ভূ মিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

তবে তথাকথিত ব্যাঙ্কিং বিজ্ঞান বা স্পষ্ট ভাবে বলা ভালো অর্থনৈতিক বিজ্ঞান ইংল্যান্ডে আবিস্কারের পরেও

ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে এই একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্ক গড়ে তোলা হলেও এগুলির চালানোর

জন্য শক্তিশালী নিয়ম বা পরিকাঠামো ছিলোনা। ১৮’শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের ব্যাঙ্কিং

ব্যাবস্থায় মূলত ইংরেজদের প্রাধান্য ছিল এবং শৃঙ্খলাহীনতার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে তৈরি হওয়া ব্যাঙ্ক

গুলি ছিল বেসরকারী এবং ব্যাক্তিগত দখলে। তবে ব্যাঙ্ক মালিকদের কাছে এই ব্যবস্থার সুবিধা ছিল অনেক
কারণ ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে জালিয়াতির কারণে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া ঘোষণা হলেই কোর্টে র নির্দে শে

ব্যাঙ্কের সমস্ত বেঁচে থাকা সম্পত্তি এবং মুদ্রা অধিগ্রহণ করা হত। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যাঙ্ক মালিক ঋণের

থেকে মুক্তি পেট অন্যদিকে তার ব্যাক্তিগত সমপত্তি কোন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হতোনা। ফলত সহজেই ব্যাঙ্ক কে

ব্যবহার করে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বাড়িয়ে নেওয়া যেত। এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার পরিকল্পনা তৎকালীন

ইউরোপের থেকে আমদানি করা হয়। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে ক্ষু দ্র শিল্পপতি বা কৃ ষকরা এই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার

পরিসরের বাইরে ছিল , ফলে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতি প্রভাবে তৎকালীন সময়ে সেইভাবে

পড়েনি। তবে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা তৈরি হওয়া প্রেসিডেন্সী ব্যাঙ্ক অফ বোম্বে ১৮৪০ সালে যাত্রা

শুরু করে এবং ১৮৬০ সাল অবধি অর্থনৈতিক লেনদেনের কাজ সুস্থ ভাবে চালিয়ে আসে এবং আমেরিকান

বাজারে তু লোর ব্যাপক চাহিদার ব্যাঙ্কের লেনদেন বাড়তে শুরু করে । তবে আমেরিকায় গৃহ যুদ্ধের ফলে তু লোর

চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্পপতিরা দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ব্যাঙ্ক সংকট দেখা দেয়। এর পরবর্তী সময়ে একের

পর এক সংকট নেমে আসে ভারতের ব্যাঙ্ক ব্যাবস্থায়। ১৯১৩ সালে থেকে স্বাধীনতা অবধি শতাধিক ব্যাঙ্ক

সংকটের ঘটনা জানা যায়। ১৯১৩-২১ সালের মধ্যে ১০৮ টি, ১৯২৬-৩৫ সালের মধ্যে ২১৫ টি এবং ১৯৩৬–

৪৫ সালের মধ্যে ৭০ টি ব্যাঙ্ক সংকট ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সময়ে সমস্ত ব্যাঙ্কগুলি ছিল বেসরকারি এবং

ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন।

তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আরবিআই তৈরি হয় এবং এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কে সম্পূর্ণ সরকারের অধীনে নিয়ে

এসে সারা ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার দেওয়া হয় হয়। তবে এই অধিকার প্রদানের পরেও

স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে যে নিয়মিত ব্যাঙ্ক সংকট শুরু হয়েছিল তা বন্ধ করতে পারেনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫
সালের মধ্যে মাত্র ৮ বছরের মধ্যে ৩৬১ টি ব্যাঙ্ক সংকট ভারতের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উপরে নেমে আসে। তবে এর

ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করে। একের পর এক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ার ফলে সাধারণ

মানুষের মধ্যে জনরোষ বাড়তে শুরু করে।

১৯৪৭ সালে আরবিআইয়ের পত্তন করা হলেও ১৯৬৯ সাল অবধি ভারতের প্রধানত বেসরকারি ব্যাঙ্ক গুলি

রাজত্ব করে। ১৯৬৯ সালের পরবর্তী সময়ে ১৪ টি ব্যাঙ্কের রাষ্ট্রায়ত্বকরণ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা

গান্ধী, যদিও এর ফলে তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি র মধ্যে দক্ষিণপন্থীদের সাথে ইন্দিরা গান্ধী পন্থীদের মধ্যে

আড়াআড়ি বিভাজন দেখা যায়। ভারতের এবং USSR এর মধ্যের গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ও কূ টনৈতিক

সম্পর্ক এবং ভারী শিল্প গড়ে তোলার ভারতের গ্রহণ করা পদক্ষেপ বাস্তব করার জন্য এই ব্যাঙ্কের রাষ্ট্রায়ত্বকরণ

ছিল অন্যতম প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এই একই পদক্ষেপ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে

তৎকালীন ফরাসী সরকার গ্রহণ করে তৈরি করেন “Circui de’ Tresor”, যার মাধ্যমে সরকার থেকে নির্দি ষ্ট

দামে সিকিউরিটি কিনে নেওয়া হয়। ফলে সরকারের কাছে কাঁচা টাকার জোগান থাকে এবং এই টাকা বাজারে

আসার ফলে সাধারণ মানুষের উপকার হয়। বেঞ্জামিন লেমোইনের মতে এই পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সাদাহ্রন

মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে যায় এবং গরীব মানুষের ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা কমে যায়।

১৯৬৯ সালের পর থেকে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্বকরণ করার ফলে ব্যাঙ্কগুলি নিজেদের সম্পত্তির ২০% সিকিউরিটি

স্বরূপ আরবিআইয়ের কাছে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য হয়। এছাড়া বাকি সম্পত্তির ৪০% অন্যান্য ঋণ প্রদানের

কাজে ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং বাকি ৪০% গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন কৃ ষি, ক্ষু দ্র শিল্প

ইত্যাদি অংশে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয় যাতে সাধারণ মানুষের উন্নতিসাধন সম্ভব হয়। এই পদক্ষেপ
গ্রহণ করা হয় ভারতের জাতীয় পুঁজিপতিদের কথা মাথা রেখে। জাতীয়করণ হওয়া সত্বেও শিল্পোন্নতির পক্ষে

ব্যাঙ্ক গুলি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় শিল্প গুলির বেড়ে উঠতে শুরু করে। এছাড়াও ভারতের রুদ্ধ

অর্থনীতির ফলে বিদেশী বৃহৎ পুঁজির সাথে কম্পিটিশন করতে থেকে বেঁচে যায় এই শিল্প গুলি এবং এদের

লাভের ফলে ব্যাঙ্ক গুলির লেনদেন বাড়তে থাকে। যার ফল স্বরূপ ব্যাঙ্ক শিল্প দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পরে এবং

ভারতের অর্থনীতির সবথেকে মজবুত মেরুদণ্ড হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় সফার জাতীয়করণের

সময়ে আর ৬ টি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা হয়।

১৯৯১ সালের সংকটের পরে ১৯৯২ সালে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ শুরু হয়। একধাক্কায় উদারীকরণের

ফল স্বরূপ নির্ণায়ক লিকিউডিটি অনুপাত (Regulatory liquidity ratio) কমিয়ে ২৫% করা হয়। এছাড়াও

ঋণ প্রতি সুদের হার এবং জমা খাতে সুদের হারের পরিমাণ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে নিয়ম গুলি শিথিল করা হয়।

ফলে একধাক্কায় বিদেশী ব্যাঙ্ক গুলি কে ব্যবসা করার সুযোগ পেয়ে যায়। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে

৭ টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক তাদের যাত্রা শুরু করে ভারতের বাজারে। এছাড়াও ১৯৯৪ থেকে আজ অবধি ভারতে

২০টির বেশি বিদেশী ব্যাঙ্ক ভারতে ব্যবসা করছে। তবে এই উদারীকরণের পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া গ্লোবাল

ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক এই শিথিল নিয়মের সুযোগ নিয়ে একের পর এক জালিয়াতি ঘটিয়ে চলে। ২০০০ সালের শেয়ার

মার্কে ট জালিয়াতির ঘটনায় এই ব্যাঙ্কের ভূ মিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এত কিছুর পরেও বলা যায় যে ১৯৯২

সালের পর থেকে বেসরকারিকরণ শুরু হলেও ব্যাঙ্ক বিক্রির চক্রান্ত করা হয়নি। নতু ন ব্যাঙ্ক তৈরি হলেও পুরনো

সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি কে বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। তবে ২০২১ সালের বাজেটে সরকারের ব্যাঙ্ক গুলি বিক্রির

মাধ্যমে আত্মনির্ভ র করার যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে ভারতের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া যাবে তা পূর্ববর্তী সমস্ত বেসরকারিকরণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা গুলি থেকে চরিত্রগত

ভাবে আলাদা। তবে উদারীকরণের পরেও ভারতে বেঁচে থাকা শক্তিশালী সরকারি ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ফলে ২০০৮

সালের বিশ্বজুড়ে নেমে আসা সংকটের থেকে ভারতের বাজার কে বাঁচানো গিয়েছিল, কারণ আমেরিকার মত

অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ তু লনামূলক কম ছিল এবং সংকট পরবর্তী সময়ে এই ব্যাঙ্ক গুলি ভারতের

অর্থনীতি কে পুনরায় চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছিল।

ফলত এই অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস চর্চা থেকেই বলা যায় যে মধ্য যুগ থেকে ভারত জুড়ে যে শক্তিশালী

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা একদিনের চেষ্টায় সম্পূর্ণ বদলে ফেলা সম্ভব নয়। একের পর এক

ব্যাঙ্ক জালিয়াতি বেসরকারিকরণের এই পদক্ষেপ গ্রহণের প্লট রচনা করছিলো। দ্বিতীয় কংগ্রেস নেতৃ ত্বাধীন

সরকারের সময় থেকে একের পর এক জালিয়াতির নাম আমাদের সামনে আসতে শুরু করে। রঘুরাম রাজন

তার একটি ইন্টারভিউ তে প্রকাশ্যে ইউপিএ-১ এবং ২ সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে ২০০৬-০৮

সালের মধ্যে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির ব্যালেন্স শিটে অফেরত যোগ্য ঋণ জমা হতে শুরু করে। এর অন্যতম

প্রধান কারণ ২০০৬-১২ সাল পর্যন্ত বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট গুলিতে সরকার জলের দরে সুদ দিতে শুরু

করে। এর ফলে জিডিপি বাড়তে শুরু করলেও বাস্তবে সাধারণ মানুষের চোখে পড়ার মত লাভ হয়নি। ২০১১

সালের পরবর্তী সময়ে দেশ জুড়ে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। আন্না হাজারের নেতৃ ত্বে শুরু হওয়া এই

আন্দোলন খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি দিল্লী তে সরকার

পরিবর্ত ন হয়ে এই দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল “আম আদমি পার্টি ”

ক্ষমতা দখল। যদিও আজকে দাঁড়িয়েও বিজেপি দিল্লীতে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি কিন্তু এই আন্দোলনের সাহায্যে
বিজেপি সারা দেশ জুড়ে কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে সফল হয়। ফলত একের পর

দুর্নীতির ফলে ভারতের শক্তিশালী সরকারি ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা যে ঋণের ভারে জর্জ রিত হয়ে পরছিল তা স্পষ্ট হয়ে

উঠেছিল। বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের শুরু থেকেই নরেন্দ্র মোদী সরকার এই

রাজনৈতিক হাওয়া কে কাজে লাগিয়ে বেসরকারিকরণের পদ্ধতি শুরু করেন। কিত্নু এই সময়ে দাঁড়িয়েও

পরিস্থিতি সরকারের হাতের বাইরে যায়নি ফলে দ্বিতীয় দফার এনডিএ সরকারের তু লনায় বেসরকারিকরণ করার

বিষয়ে প্রথম এনডিএ সরকারের ক্ষিপ্রতা অনেক কম ছিল।

তবে ২০১৮ সালে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক সংকট আমাদের সামনে নতু ন অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট হাজির করে যা

সামগ্রিক ভাবে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা নয় বরং সারাদেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের উপর প্রশ্ন তু লে দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী

সময়ে ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ পূর্ববর্তী সময়ে যে ভাবে একের পর এক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা

ইতিহাস থেকে জানতে পারি বর্ত মান সময়ে এই একই অবস্থা আমাদের সামনে হাজির হয়। ২০১৮ সালের

সংকটের ক্ষেত্রে দেখা যায় পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক আধিকারিক নিরব মোদী কে Letter of Undertaking

(LOU) দেয়; যার বলে সে ফ্রাঙ্কফ্রু ট, বাহারিন, হংকং, মরিশাস থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয় এবং এই ঋণের

পরিমাণ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কাছে অজানা থেকে যায়। ফলে ঋণের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়তেই থাকে

এবং এই পরিমাণ এতই বেড়ে যায় যে কোনোভাবেই নীরব মোদীর পক্ষে এই টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব

ছিলোনা। যদিও এই ঘটনার ফলে ২০১১ সালের পরে আবার পুনরায় দুর্নীতি বিষয়টি আমাদের সামনে পুনরায়

উঠে আসে। এই সময় থেকেই সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির খারাপ অবস্থা দেখিয়ে এই ব্যাঙ্ক গুলি কে

বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা আমাদের সামনে উঠে আসে। কারণ সরকার ও বেসরকারিকরণের পক্ষে থাকা
অর্থনীতিবিদদের মতে এই পদক্ষেপের ফলে ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। যদিও একথা

অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে বাস্তবিক সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৫০০

এর কাছাকাছি ঋণ খেলাপির নাম ঘোষণা করে আরবিআই এবং এই ঋণ খেলাপিদের নেওয়া বিপুল পরিমাণ

ঋণের বোঝার একটা বিরাট অংশের বোঝা চাপানো হয় সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির ঘাড়ে। ফলত বাড়তে থাকা

ঋণের বোঝার সামনে পরে অনেক সরকারি ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হওয়ার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে এমতাবস্থায় কি বেসরকারি ব্যাঙ্ক গুলির অবস্থা খুব ভালো? আমরা যদি শেষ কয়েক বছরের

বেসরকারি ব্যাঙ্ক গুলোর অবস্থা খেয়াল করি তাহলে দেখা যাবে ঋণের বোঝার পরিমাণ এই ব্যাঙ্ক গুলির

সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির সাথে সমপরিমাণে বাড়ছে। ২০২০ সালের ইয়েস ব্যাঙ্ক সংকটের ঘটনা পুনরায় প্রমাণ

করে যে ঋণের কালো থাবা থেকে সরকারি বা বেসরকারি কোন ব্যাঙ্ক মুক্তি পায়নি। ২০১৮ সালের পাঞ্জাব

ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সংকট এবং ২০২০ সালের ইয়েস ব্যাঙ্ক সংকটের মধ্যে একাধিক মিল দেখা যায়।

নয়াউদারবাদের পোষ্টারবয় ইয়েস ব্যাঙ্ক তাদের যাত্রা শুরুর পর থেকেই একের পর এক মাইলস্টোন তৈরি করতে

শুরু করে। কিন্তু ২০২০ সালে এই আচমকা ধাক্কা অনেকের কাছেই আশ্চর্যজনক ছিল। পরবর্তীতে দেখা যায়

২০১৫ সালে আরবিআই ব্যাঙ্ক গুলির ঋণ ও সম্পত্তি সম্পর্কে রিপোর্ট চাইলে ইয়েস ব্যাঙ্ক সহ একাধিক

বেসরকারি ব্যাঙ্ক তাঁদের ঋণের পরিমাণ বাস্তবের থেকে কমিয়ে দেখায়। ফলে এই পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ২০২০

সালে এসে অর্থনৈতিক ধ্বসের সম্মুখীন হয়। ইয়েস ব্যাঙ্ক সংকটের কারণ হিসেবে যে সমস্ত ঋণ খেলাপির নাম

প্রধানত উঠে আসে তাঁরা হলেন অনিল আম্বানি, এসেল গ্রুপ, রেডিয়াস ডেভেলপারস, ক্যাফে কফি ডে

ইত্যাদি এবং এরাই বিজেপি কে সব থেকে বেশি চাঁদা দেয়। যদিও সব জানা সত্বেও সিবিয়াই এদের বিরুদ্ধে
কোন পদক্ষেপ এখনো অবধি গ্রহণ করেনি। তবে শুধু ইয়েস ব্যাঙ্ক নয় বরং অন্যান্য ব্যাঙ্ক গুলির অবস্থা আলাদা

নয়। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের সিইও চন্দা কোচর কে তার পদ থেকে অপসারিত করা হয় কারণ

অফেরতযোগ্য ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছিল। এছাড়া ইয়েস ব্যাঙ্কের সিইও রানা কাপুর বর্ত মানে

তদন্তাধীন রয়েছে বেআইনি লেনদেনের অভিযুক্ত হয়ে। ফলত স্পষ্টতই বলা যায় সরকারি বা বেসরকারি উভয়

ব্যাঙ্কের অবস্থা একই।

তবে এই বেসরকারিকরণ বা বেসরকারি ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ উভয় পরিকল্পনার ক্ষেত্রেই যে ভাবে সরকারি

ব্যাঙ্ক গুলি কে বাঁচানোর এজেন্ডা কে সামনে আনা হচ্ছে তাতে দাঁড়িয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে সত্যি কি

বাস্তবিক সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির অবস্থা এতই সঙ্গিন যে সংযুক্তিকরণ বা বেসরকারিকরণ বাদে অন্য কোন উপায়

নেই। ভারতে বর্ত মানে অফেরতযোগ্য ঋণ বা এনপিএয়ের সর্বমোট পরিমাণ ১০% এবং সরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে

এই পরিসঙ্খায়ন ১২.৫%। একই সময়ে যদি আমরা অন্যান্য দেশ গুলির পরিসংখ্যান গুলির দিকে দেখা যায়

তাহলে আমরা পাবো – গ্রিসের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৪৬ %, সাইপ্রাসে ৪৪%, পর্তু গাল ১৭%, সোলভেনিয়ায়

১৩%, বুলগেরিয়া-ইতালি-আয়ারল্যান্ডে ১২% এবং হাঙ্গেরির ক্ষেত্রে এই সূচক ১১% (২০১৭ সালের তথ্য

অনুযায়ী)। অর্থাৎ একাধিক দেশে এই সূচকের পরিমাণ ভারতের থেকে বেশি হলেও সেই দেশ গুলির ক্ষেত্রে

এই বেসরকারিকরণ এবং সংযুক্তিকরণের দরকার পড়েনি। তাহলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই খিপ্তার সাথে

বেসরকারিকরণের প্রয়োজন কি?

নয়াউদারবাদ পরবর্তী সময়ে ভারত রাষ্ট্রের দর্শন গত পরিবর্ত ন ঘটে অর্থাৎ পূর্বের রাষ্ট্র যেখানে শুধু মুনাফার

জন্যে নয় বরং ব্যবসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কল্যাণের নুন্যতম চেষ্টা করতো, আজকে দাঁড়িয়ে সেই সেই
জনকল্যাণকামী মুখোশ ছিঁ ড়ে ফেলে স্পষ্ট ঘোষণা করা হচ্ছে রাষ্ট্র তার সমস্ত উন্নতিমূলক কাজ কর্মের দায়

ঝেড়ে ফেলছে। বর্ত মান ব্যবস্থা শুধু মাত্র ধনীদের আরো ধনী করার দায় নিয়েছে। ঠিক তাই জন্যেই সরকারি বা

বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির খারাপ স্বাস্থ্যের কারণ হাতে গোনা কিছু শিল্পপতি যারা শ্রেণীগত ভাবে বুর্জোয়া, ক্ষু দ্র

কৃ ষি ঋণ বা গৃহ ঋণ ফেরত দিতে না পারার কারণে এই সংকট গড়ে ওঠেনি। আদতে এই ভঙ্গুর ব্যবস্থার নির্দি ষ্ট

সময় অন্তর সংকটের মধ্যে পরে এবং সরকারের আনুকূ ল্যে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে সংকট থেকে মুক্তি পায়।

২০২০ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় থেকেই কিছু বিষয় আমাদের সামনে দিনের আলোর মত পরিষ্কার

হয়ে উঠতে শুরু করে। এই সংকট ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সর্ববৃহৎ সংকট এবং এই সংকট নিছক

লকডাউনের ফলে হয়নি। এই সংকটের বারুদ অনেকদিন আগে থেকেই জমা হচ্ছিলো। একের পর এক

রিপোর্ট প্রমাণ করছিলো যে শিল্পপতিদের ব্যবসা গুলো আগের মত অবস্থায় নেই। উৎপাদনের পরিমাণ

কমছিলো। অভিজিত বন্ধপাধ্যায় তার বইতে উল্লেখ করেন যে অর্থনীতির অবস্থা এত খারাপ যে বিস্কু ট তৈরির

কারখানা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে কারণ বিক্রি বন্ধ। অর্থাৎ মানুষের আহতে পার্লে-জি বিস্কু ট কেনার ক্ষমতা নেই।

তাই এই বছর গুলিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যে জলের দরে ঋণ প্রদান করছিলো সরকার। এই বক্তব্য

আরো স্পষ্ট হয় শেষ কিছু বছরের রেপো রেটের পরিবর্ত ন খেয়াল করলে-

পরিবর্তি ত রেপো রেট (শতাংশের হিসাবে)


জানুয়ারি ২০১৪ ৮
জানুয়ারি ২০১৫ ৭.৭৫
মার্চ ২০১৫ ৭.৫
জুন ২০১৫ ৭.২৫
সেপ্টেম্বর ২০১৫ ৬.৭৫
এপ্রিল ২০১৬ ৬.৫
অক্টোবর ২০১৬ ৬.২৫
আগস্ট ২০১৭ ৬
জুন ২০১৮ ৬.২৫
আগস্ট ২০১৮ ৬.৫
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ৬.২৫
এপ্রিল ২০১৯ ৬
জুন ২০১৯ ৫.৭৫
আগস্ট ২০১৯ ৫.৪
অক্টোবর ২০১৯ ৫.১৫

বর্ত মানে এই পরিমাণ সর্বকালীন সর্বনিম্ন সূচকে (৪%) পৌঁছেছে। আসলে রেপো রেটের এই পরিবর্ত ন স্পষ্টতই

বুঝিয়ে দেয় আসলে তথ্য থাকা সত্বেও সরকার এই ঋণের বোঝা কমানোর কোন চেষ্টা করেনি। বরং প্রতি বছর

আরো বেশি করে ঋণ পুঁজিপতিদের দিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ২০২০ সালের মার্চ মাসের সংকট কে

আটকানো যায়নি। ফলে এই সংকটের ঘটনা আরো স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয় যে এই ধরণের সংকট পরবর্তী তে

সামনে এলে পুঁজিপতিদের বাঁচাতে চাই টাকার বিপুল ভাণ্ডার যা দিয়ে তাঁরা বাজারে টিকে থাকতে পারবে। তাই

দ্রুততার সঙ্গে এই বেসরকারিকরণ এবং সংযুক্তিকরণের ঘোষণা করা হয়েছে।

তাই বর্ত মান সময়ে কিছু স্পষ্ট দাবী জনগণের সুবিধার জন্য করা দরকার। নিম্নলিখিত দাবী গুলি নিয়ে

আন্দোলনের মাধ্যমেই একমাত্র ভারতের সরকারি ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা কে টিকিয়ে রাখা যাবে শুধু তাই নয়; বরং

সাধারণ মানুষের নুন্যতম নিঃশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে-


১. পুঁজিপতিদের কারণে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলির যে ক্ষতি হয়েছে তা সেই পুঁজিপতিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে

পূরণ করতে হবে।

২. অভিযুক্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিক এবং জালিয়াতির ফলে লাভবান সংস্থার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে

হবে।

৩. সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি কে সব ধরণের ফাটকা লেনদেন বা ডেরিভেটিভ লেন্দেনে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে

এবগ্ন বেসরকারি সংস্থা গুলি কে নির্দি ষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

৪. বেসরকারি সংস্থা গুলিকে সরকারি সিকিউরিটি ছাড়া সম্পূর্ণ বেসরকারি খাত থেকে নিজেদের ব্যবসার জন্য

প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে হবে। কোন সরকারি ব্যাঙ্ক বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোন বেসরকারি সঙ্কস্থা

কে সাহায্য করবেনা।

৫. আরবিআই কে অডিটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজেদের নিতে হবে এবং কোন রকম বেসরকারি অডিট ফার্ম কে

দিয়ে অডিট করানো চলবেনা। এক্ষেত্রে অডিটের প্রশ্নে সব ধরণের স্বচ্ছতা সুরক্ষিত করতে হবে। এছাড়াও

আরবিআই কে ব্যাঙ্ক গুলির উপর নির্ণায়ক নিয়ম গুলি কে শক্তিশালী করতে হবে।

অবিলম্বে এই দাবী গুলি মেনে নিয়ে সরকার যদি যথোপযুক্ত ভূ মিকা নেয় তাহলেই একমাত্র জনগণের সম্পদ

সরকারি ব্যাঙ্ক গুলিকে বাঁচানো যাবে। সাধারণ মানুষ তাঁদের সারা জীবনের অর্জি ত সম্পত্তি এই ব্যাঙ্ক গুলিতে

রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। অন্যথায় আমাদের একজনের সম্পত্তিও সুরক্ষিত নয়। তাই আজকে দাঁড়িয়ে

এই দাবী গুলি যাতে সরকার মেনে নেয় তার জন্যে লড়াই শুরু গড়ে তু লতে হবে এবং কোন দাবী জনগণের
সামনে নিয়ে আসার সব থেকে ভালো সময় ভোট। তাই বর্ত মান ভোট হয়ে উঠু ক এই দাবী নিয়ে লড়াই গড়ে

তোলার মঞ্চ।

You might also like