Download as docx, pdf, or txt
Download as docx, pdf, or txt
You are on page 1of 7

ইসলামি আহকাম অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের স্বরূপ

সুরা আল ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে- "তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি (অথবা একাধিক দল হোক, যারা আল খায়ের
(অর্থাৎ ইসলাম)-এর দিকে আহবান করে, সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজের নিষেধ করে এবং তারাই সফলকাম।"

এই আয়াতের দুটি আলোচনা পর্যায় রয়েছে যা আমরা অনুসন্ধান করব। প্রথম পর্যায়ে আমাদের উপর্যুক্ত আয়াতের তাফসীর অর্থাৎ আয়াতের
ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আলোচনা করব। দ্বিতীয় পর্যায়ে 'তাশরি' সংক্রান্ত অর্থাৎ আয়াতের শার’আ ও হুকুম সংক্রান্ত আলোচনা।

আমরা অনেকেই তাফসীর ও তাশরি-এর ব্যাপারদ্বয়কে গুলিয়ে ফেলি। অনেক ভাইয়েরাই যারা তাফসীর শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, তা থেকে আহকাম
নেয়ার চেষ্টা করেন; বিশেষ করে সেই সকল মুফাস্‌সিরিনের তাফসীর থেকে যারা মুজতাহিদ পর্যায়ের। কেননা অনেক মুজতাহিদ মুফাস্‌সির তাদের
তাফসীরে আহকাম উল্লেখ করে থাকেন যা তার নিজস্ব। তাফসীর হচ্ছে শুধুমাত্র আয়াতের ব্যাখ্যা। অন্যদিকে 'তাশরি' ইজতিহাদ হচ্ছে
মুফাস্‌সিরের নিজস্ব মতামত। কেননা মুজতাহিদ মুফাস্‌সিরের বিশেষ আয়াতের ব্যাখ্যায় নিজস্ব মত ও আহকাম সংক্রান্ত অভিমত থাকতেই পারে।

(Text of the Quran)-এর ব্যাখ্যাকে তাফসীর এবং (Text of the Hadith)-এর ব্যাখ্যাকে শারহ বলে। এই সম্বোধনগুলো ফু কাহা ও
উলামারা ব্যবহার করে থাকেন। তাফসীর কুরআনের অর্থ বোঝাতে এবং শারহ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাদীসের অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তাই তাফসীর বা শারহ হচ্ছে কুরআন ও হাদিসের অর্থ বা ব্যাখ্যা। কিন্তু 'তাশরি' হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসা বুঝায়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাফসীরের প্রয়োজনীয়তা কী? যে কেউ ইজতিহাদ করতে চায় অথবা আহকাম জানতে চায় তার অবশ্যই আয়াতের
তাফসীর বা ব্যাখ্যা জানতে হবে। কারণ তাফসীরের উপর নির্ভ র করেই তাশরি’ করা হয়। কিন্তু আমাদের অবশ্যই আয়াতের তাফসীর এবং
মুফাস্‌সিরের নিজস্ব মতামতের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। মুজতাহিদের ইজতিহাদকে তাফসীর বলে ভু ল করা যাবে না। কারণ নতু ন করে কোনো
ইজতিহাদ করার জন্য শুধুমাত্র তাফসীর বা ব্যাখ্যা নেয়া প্রয়োজন, মুফাস্‌সিরের নিজস্ব মতামত নয়। অথবা আমরা সংযোজন করতে পারি
মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃ ত আহকাম।

সুতরাং প্রথমেই আমাদের আলোচনার বিষয় আয়াতের ব্যাখ্যা অর্থাৎ তাফসীর উপরিউক্ত আয়াতের প্রথম শব্দটি হচ্ছে 'ওয়ালতাকুন'। এই
আয়াতের প্রথমবর্ণ হলো 'ওয়াও' ['The Waw al Atf']। ওয়াও এটি একটি সংযোগ বর্ণ। এই বর্ণের মাধ্যমে উল্লেখিত আয়াতের পূর্বে বর্ণিত
অনেকগুলো আয়াত উক্ত আয়াতের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন দাঁ ড়ায় পূর্বের আয়াতগুলো কেমন? কারণ আয়াতসমূহের সংযুক্তি বোঝার
জন্য পূর্বের আয়াতগুলোর পর্যালোচনা প্রয়োজন।

সুরা আল ইমরানের ১০৪ নং আয়াত থেকে শুরু করে পরবর্তী অনেকগুলো আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের লক্ষ্য করে কথা বলেছেন-

"হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছ তোমরা যদি আহলে কিতাবদের কোনো একটি দলের কথা মেনে চলো, তাহলে (মনে
রেখো), ঈমান আনার পর এরা (ধীরে ধীরে) তোমাদের কাফির বানিয়ে দেবে।" [সূরা আলে ইমরান ৩:১০০]

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌বলেছেন-"তোমরা কীভাবে কুফরি করবে যখন তোমাদের সামনে (বার বার) আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত
করা হচ্ছে। তাছাড়া এ আয়াতের বাহক স্বয়ং তাঁ র রাসূল যখন তোমাদের মধ্যেই মজু দ রয়েছে, যে ব্যক্তিই আল্লাহ ও তাঁ র বিধানকে
শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে, তাকে অবশ্যই সোজা পথে পরিচালিত করা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরান ৩:১০১]

এইখানে আল্লাহ মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেন যে তোমরা তাদের (কাফির) মতো হয়োনা যেহেতু তোমাদের মাঝে কুরআন ও হাদীস [অর্থাৎ
রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর বাণী] বিদ্যমান। "তোমাদের মাঝে" কথাটির অর্থ কী? তা লাইব্রেরির মাঝে নয়, ঘরের মাঝে নয়; বরং তা আপনি ও আপনার
কর্মের মাঝে বিদ্যমান। অর্থাৎ আপনি কুরআন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন করছেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করছেন।

এর পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন: "হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহকে ভয় করে (তার ক্রোধ হতে) বেঁচে থাকো,
সত্যিকার অর্থে (তা করো) যেভাবে ভয় করা উচিত। এবং মুসলিম (তাঁ র কাছে সম্পূ র্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে মৃত্যুবরণ করো
না।"
এইরূপ কুরআনের অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ বলছেন- "এবং পালনকর্তার এবাদত করুন, যে র্পযন্ত আপনার কাছে ইয়াকীন (নিশ্চয়তা)
না আসে (অর্থ: মৃত্যু)" [১৫:৯৯] এখানে নিশ্চয়তার কথা বলতে মৃত্যু বোঝানো হচ্ছে। সুতরাং আল্লাহর ইবাদত, আল্লাহর কাছে এস্তগেফার
এভং আল্লাহকে সঠিকভাবে ভয় করতে হবে মৃত্যু র্পযন্ত।"

আল ইমরানের ১০৩নং আয়াতে বলা হচ্ছে- "তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু কে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো।" এখানে রজ্জু বলতে
কুরআন ও সুন্নাহকে বোঝানো হচ্ছে।

একই আয়াতে আল্লাহ আরো বলেছেন- "আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা
পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁ র অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই
ভাই হয়েছ।" যেমন- হিজরতের পর আনসার সাহাবিরা মুহাজিরদেরকে নিজেদের অর্থ এমনকি স্ত্রীও বণ্টন করে দিতে চেয়েছিলেন ভ্রাতৃ ত্বের
কারণে।

একই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেছেন- "তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদের মুক্তি
দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হতে পারো।" [সূরা আলে ইমরান
৩:১০৩]

সুতরাং, ১০৪নং আয়াতের পূর্বের সবগুলো আয়াতে বলা হয়েছে কাফের না হওয়ার কথা, কাফেরদের অনুসরণ না করার কথা, আল্লাহকে মান্য
করার কথা, আল্লাহকে সঠিকভাবে ভয় করার কথা, ভ্রাতৃ ত্বের বন্ধনের কথা এবং ঐক্যের কথা যার প্রত্যেকটিই ইসলামে ফরয বিষয়। যা মানা
বাধ্যতামূলক।

সুতরাং, ১০৪নং আয়াতে উল্লিখিত (ওয়াও) সংযুক্তি বর্ণটি উপরের আয়াতসমূহে বর্ণিত সকল বাধ্যতামূলক কাজের সাথে সংযোগ তৈরি করেছে।
এই বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে 'তাশরি' সংক্রান্ত আলোচনায়।

১০৪নং আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে- 'ওয়ালতাকুন'। এখানে 'লাম' (‫ )ل‬হচ্ছে 'Laam of Amr' তথা নির্দে শসূচক লাম। এই বর্ণের মাধ্যমে
আল্লাহ আমাদের বিশেষ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

'ওয়ালতাকুন' বলতে এখানে 'ফে’ল' বা ক্রিয়া বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ পক্ষ থেকে 'ফে’ল আমর' বা নির্দে শসূচক ক্রিয়া বোঝানো
হচ্ছে। এর পরে বলা হয়েছে- 'মিন'। এর দুটি অর্থ হতে পারে-

১) প্রথম অর্থ হতে পারে 'তোমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক' যাকে তাব’ঈদ বলা হয়।
২) দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, 'জিন্‌স' যার দ্বারা প্রকার বোঝায়। যেমন- ইংরেজিতে বলা হয় from (হতে বা থেকে)। যদি বলা হয় give me
your son and I will make from him a good fighter (অর্থ- আপনার ছেলেকে দিন, আমি তার হতে বা থেকে বা দ্বারা ভালো
যোদ্ধা বানাব।) সুতরাং হতে বা থেকে বলতে পরিপূর্ণতা বোঝানো হচ্ছে, অংশবিশেষ নয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণরূপেই ভালো যোদ্ধা, অংশবিশেষ ভালো
যোদ্ধা আর অংশবিশেষ খারাপ এমন নয়। 'হতে' বা 'থেকে' বলতে সম্পূর্ণতা বোঝানো হয়। এটাকে 'বয়ান আল জিন্‌স' বলা হয়।

সুতরাং উপরের দুটি অর্থের যে কোনোটি হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ সমগ্র উম্মতকে নির্দে শ দিয়েছেন। এটাকে বলা হয় 'লি'ইল তাব’ঈদ ওয়া
বয়ান আল জিন্‌স'। দুটি সম্ভাব্য অর্থের যেকোনো একটি হতে পারে। যা আমাদের 'তাশ্‌রি' সংক্রান্ত আলোচনায় মনে রাখতে হবে।

এরপর বলা হয়েছে- 'কুম'। এখানে 'কুম' হচ্ছে (‫ )ضمير‬বা সর্বনাম। সুতরাং এখানে কাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে? এখানে সম্বোধন করা
হয়েছে 'হে ঈমানদারগণ' বলে। সেভাবে এর পূর্ববর্তী আয়াতাগুলোতেও পাশাপাশি সম্বোধন করা হয়েছে 'হে মুসলিম' বলে। যা আমাদের 'তাশরি'
সংক্রান্ত আলোচনায় মনে রাখতে হবে।
পরবর্তীতে বলা হয়েছে- 'উম্মাতু ন' অর্থাৎ এক বা একাধিক দল যারা খায়র (ইসলামের) দিকে আহবান করে। এই আহবানকারীদেরকে অর্থাৎ
'সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নির্দে শ করতে হবে। এবং তখনই 'ওয়া উলাইকা হুমুহুল মুফলিহুন' অর্থাৎ তারা হবে সফলকাম।

এখন আপনারা যে কোনো তাফসীর বইতে এরূপ ব্যাখ্যা দেখবেন তা হবে শুধুই তাফসীর। এর বাইরে বা অতিরিক্ত যা কিছুই দেখবেন তা হচ্ছে
'তাশ্‌রি' এবং মুফাস্‌সিরের নিজস্ব মতামত। [মুফাস্‌সিরের ইজতিহাদ]। সুতরাং, এই পার্থক্যাদির ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। এবার আপনারা
সকল তাফসীর, বই যেমন- ইমাম কুরতু বী, ইমাম ইবন জরীর, আত্‌তাবারী, ইবন কাসীর এবং অন্য যে কোনো কিতাবে আপনি এইরূপ তাফসীর
বা ব্যাখ্যা দেখতে পাবেন। পাশাপাশি অনেক পার্থক্য দেখতে পবেন 'তাশরি' সংক্রান্ত বিষয়ে।

এখন আমরা নিজেদেরকেই প্রশ্ন করি কীভাবে আমরা আহকাম বের করে নিব। আজকাল আয়াত থেকে আহকাম বের করে আনা একটি কঠিন
ব্যাপার হয়ে দাঁ ড়িয়েছে। অতীতে এটা অনেকটাই সহজ ছিল। আমরা দেখি, আরব বেদুঈন, যারা ছিল অশিক্ষিত, তারা যখনই কোনো হুকুম সম্বন্ধে
জনতে চাইত তৎক্ষণাৎ মদীনায় চলে আসত যেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) উপস্থিত ছিলেন। তারা সেখানে বাজারে, দোকানে মানুষের সাথে সাক্ষাৎ
করে বলত, আমাকে এই মাসআলা বা বিষয়টির ক্ষেত্রে সাহায্য করুন। তারা জিজ্ঞেস করত না আপনার পরিচয় কী? অথবা জানতে চাইত না কে
আবু বকর (রা.), কে উমর (রা.)। কেননা ইসলাম ওখানে বাস্তবায়িত অবস্থায় ছিল। প্রত্যেকেরই আহকাম বের করে আনার [অর্থাৎ ইজতিহাদ
করার জন্য যা প্রয়োজন তার সবই তাদের মধো বিদ্যমান ছিল] দক্ষতা ছিল। কারণ প্রত্যেকেই আহকাম (কুরআন ও সুন্নাহ) এবং আরবি ভাষায়
পারদর্শী ছিল। আজকাল অনেক ভাইয়ের সুন্দর সব ডিগ্রি ও পি.এইচ.ডি থাকা সত্ত্বেও তারা ইসলামের সাধারণ আহকাম বের করতে অপারগ। কেন
মুসলিম উম্মাহর 'হুকুম বের করার মানসিকতা' নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে? কারণ বাস্তবে ইসলাম নেই এবং মুসলিম উম্মাহ ইসলাম বাস্তবায়নে এগিয়ে
আসছে না। তাই ব্যাপারটি আমাদের কাছে অতীব কঠিন যেহেতু 'হুকুম বাস্তবায়ন' আমাদের বাস্তবতা নয় এবং খিলাফত ব্যবস্থাও আর বর্ত মান
নেই।

এখন এই আয়াতের 'তাশরি' করার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই আয়াতের তাফসীর (অর্থাৎ আরবি ভাষার সাধারণ অর্থ) দেখব। উপরের বিশ্লেষণটি হচ্ছে
আরবি ভাষার এক সাধারন বুঝ। এছাড়াও আলোচনা সংশ্লিষ্ট হাদীসও তু লে আনা হবে।

আয়াতের মধ্যে 'ওয়াও' হচ্ছে প্রথম নির্দে শনা (কারীনা)। যদিও একটি নিশ্চিত নির্দে শনা নয়। হুকুমটি জানার জন্য আমরা অন্যান্য নির্দে শনাগুলো
পর্যালোচনা করব। কারীনা বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দে শনা সম্বলিত নির্দে শ হতে পারে তা ফরজ অর্থাৎ যা পালন
করলে পুরস্কার আছে না করলে আছে শাস্তি অথবা হতে পারে মানদুব/মুস্তাহাব/নফল অর্থাৎ যা পালন করলে আছে পুরস্কার কিন্তু পালন না করলে
শাস্তি নেই। অথবা হতে পারে শুধুই মুবাহ।

যেমন আল্লাহ বলেন- নামায প্রতিষ্ঠা কর। [২৪:৫৬]। এটি হচ্ছে নির্দে শসূচক বা 'আমর'। অর্থাৎ সালাত আদায় করলে পুরস্কৃ ত হবে এবং
সালাত আদায় করা থেকে বিরত হলে শাস্তি পাবে।

আবার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) দুই রাকায়াত ফজরের পূর্বে এবং মাগরিবের পরে সালাত আদায় করতে বলেছেন, যা হলো সুন্নাহ।

এছাড়া আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরো বলেছেন- 'যখন তোমরা এহরাম থেকে বের হয়ে এসো, তখন শিকার করো (যদি চাও)'। [৫:২]
হাজীগণ হজ্বরত অবস্থায় শিকার করতে পারে না। তবে 'মানাসিক' (আনুষ্ঠানিকতা) শেষ হওয়ার পর শিকার করা যায় যেভাবে আয়াতে বলা
হয়েছে। কিন্তু ফরয বা মানদুব নয়। সুতরাং আল্লাহর নির্দে শ ও রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এর নির্দে শ হতে পারে ফরয, মানদুব, মুবাহ ইত্যাদি।

সুতরাং ১০৪নং আয়াতের শুরুতে 'ওয়াও' দ্বারা এর পূর্ববর্তী যেসকল আয়াতের সাথে সংযোগ ঘটেছে তার প্রত্যেকটিই ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ
ফরয বিষয় ব্যক্ত করেছে যেমন- জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে থাকা, ঐক্য, কাফিরদের অনুসরণ না করা, ইসলামকে আঁকড়ে ধরা ইত্যাদি। তাই
এই সংযুক্তি ফরযের দিকে নির্দে শনা ইঙ্গিত করে। যেমনিভাবে আগেই বলা হযেছে এখানে 'লাম' হচ্ছে নির্দে শসূচক 'Laam of Amr'। এই
বর্ণের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের বিশেষ বিষয় সম্পাদনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং তাই বিষয়টি ফরয হয়ে গিয়েছে।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি 'মিন' দ্বারা আরবি ভাষায় দুটি সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো কোন্‌ অর্থটি আমর নিব? এটা কি আমাদের
প্রবৃত্তির উপর ছেড়ে দিব অথবা এটি কি কোনো আবেগের বিষয়? না। আমাদের অবশ্যই আয়াতটি বুঝতে হবে এবং সবচেয়ে উপযুক্ত অর্থই বেছে
নিতে হবে।
সমগ্র উম্মতের পক্ষে খায়র অর্থাৎ ইসলামের দিকে আহবান করা এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা সম্ভব নয়। এর প্রথম কারণ
হচ্ছে সমগ্র উম্মত কখনই একই উপলব্ধিতে এবং একই দলের ব্যানারে কাজ করবে না। এছাড়াও দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো
উম্মাহর অনেকেই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে সমর্থ নয়। কিছু ব্যক্তি ইসলামের হুকুমের ব্যাপারে জাহেল। আবার কিছু ব্যক্তি
সৎকাজের আদেশ করার জন্য চিন্তাগতভাবে দুর্বল বা অযোগ্য এবং এর পাশপাশি অন্যান্যদের বিভিন্ন ওজর বিবেচনায় রাখতে হবে। সুতরাং
প্রাসঙ্গিক ভাবেই আমরা 'লিই'ল তাব’ঈদ' অর্থাৎ 'তোমাদের মধ্যে অংশবিশেষ'।

এরপর বলা হয়েছে 'কুম' যার অর্থ 'তোমরা' অর্থাৎ 'মুসলিমেরা'। সুতরাং এই দলটি অমুসলিমদের মধ্যে হলে তা হারাম হবে। এর সদস্যরা কেউ
কাফির হতে পারবে না। শুধুমাত্র ইসলামি আকীদার ভিত্তিতে মুসলমানরাই হতে পারবে।

একইভাবে 'উম্মাতু ন' দ্বারা বোঝানো হচ্ছে এটিকে অবশ্যই উম্মাহর মধ্যে হতে হবে। হবে না কোনো জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যেমনিভাবে
বর্ত মানে অনেক ইসলামি নাম রয়েছে পাশাপাশি তাদের অমুসলিম সদস্যও রয়েছে অথবা এমন কিছু পলিসির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে যা সম্পূর্ণ
হারাম। এর প্রত্যেকটিই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেহেতু এখানে 'উম্মাতু ন' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এখানে কি অন্য শব্দ ব্যবহার করা যাবে? উক্ত দলের নাম কি অবশ্যই 'উম্মাহ'
হতে হবে। যেমন- 'উম্মাহ ইসলামিয়া' উম্মাহর পরিবর্তে হিযব বা জামাআত বা কুতলা বা ফিরকাহ ইত্যাদি শব্দ কি ব্যবহার করা যাবে? নাকি এর
বাইরে যাওয়া হারাম হবে? 'উম্মাহ' শব্দটি কি শর’ঈ অর্থ বহন করছে? শর’ঈ অর্থ বলতে বুঝায় যখন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কোনো
সাধারণ আরবি শব্দকে বিশেষ অর্থ প্রদান করেন। যেমন: 'সালাত' শব্দটির আরবি পরিভাষা হচ্ছে দু’আ। কিন্তু যখন তা মাগরিবের দু’আ হয় তখন
তা হয়ে যায় সালাত। এমননিভাবে বলা যায় জিহাদ, যাকাত ইত্যাদির কথা যেগুলোকে পরিবর্ত ন করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। কিন্তু, যদি এটি শুধুই
পারিভাষিক অর্থ বহন করে সেক্ষেত্রে শব্দ পরিবর্ত নে সমস্যা নেই। সুতরাং যেহেতু এখানে শুধুই পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তাই এই
দলটিকে 'জামা’আত' বললেও সমস্যা হবে না। বর্ত মানে আপনি যদি জামাআত শব্দটি দলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন তবে আপনার কোনো সমস্যার
সম্মুখীন হতে হবে না। এবং একই কথা 'কুতলার' ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু আপনি যদি 'হিযব' শব্দটি ব্যবহার করেন তাহলে সমস্যার সম্মুখীন হতে
হবে।

অনেকেই প্রশ্ন করবে কীভাবে আপনারা নিজেদেরকে হিযব বলতে পারেন? অনেকেই এই ধারণাটিকে পছন্দ করেন না। তাদের জন্য কুরআনের
এই আয়াতটিই যথেষ্ট যেখানে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন- "তোমাদের কাছে হয় তো কোনো একটি বিষয় পছন্দসই নয়,
অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তবা কোনো একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্য
অকল্যাণকর। বস্তুত; আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। [২:২১৬]। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) 'হিযব' শব্দটি কুরআনে নবী ও
সাহাবীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। যেমন- আল্লাহ বলেন-"তারাই আল্লাহর দল। জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সফলকাম।" [৫৫:২২] আল্লাহ
হিযব শব্দটি ব্যবহারে নিষেধ করেননি। হিযব শব্দটির দুইটি অর্থ হতে পারে। পারিভাষিক অর্থটি হচ্ছে 'মানুষের দল'। যেমন- কোনো সেনাবাহিনী বা
কোনো গোত্রকেও হিযব বলা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ রাজনৈতিক অর্থটি হচ্ছে এমন একটি দল যার সদস্যরা একই আদর্শ ও মতে
বিশ্বাস করে, তা চর্চা করে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।

এই দলটিকে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেছেন- ( ‫ )َيْدُع وَن ِإَلى اْلَخْيِر‬অর্থাৎ, তারা অবশ্যই ইসলামের দিকে আহবান করবে।' সুতরাং প্রথমে আল্লাহ
(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এই দলের সদস্যদের মুসলিম হতে বলেছেন এবং এরপর তাদেরকে আহবান করতে বলেছেন এর 'কনসেপ্ট'-এর
দিকে। অর্থাৎ এই দলটির সদস্যরা হবে মুসলিম এবং 'ইসলাম' হবে তাদের কনসেপ্ট। এ থেকে বুঝা যায় যে, দলটিতে কোনো অমুসলিম সদস্য
থাকা যেমনি হারাম তেমনিভাবে হারাম হবে কোনো অনৈসলামিক আহবানের ভিত্তিতে দল করা যেমন- সমাজতান্ত্রিক দল, কম্যুনিস্ট দল,
গণতান্ত্রিক দল অথবা পুঁজিবাদী দল যার প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণরূপে হারাম। 'ওয়া ইয়া‘মুরুনা বিল মা’রূফ ওয়া ইয়ানহাওনা আনিল মুনকার' অর্থাৎ
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথমেই আল্লাহ দলটিকে ইসলামের দিকে আহবান করতে বলেছেন এবং বিশেষভাবে বলেছেন সৎকাজের আদেশ ও
অসৎকাজের নিষেধ করতে।

আমরা সবাই জানি, সাধারণভাবেই সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করা ইসলামে ফরয এবং ইসলামের অংশ। তারপরও এখানে
বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ কী?

এখানে 'আল খায়র' হচ্ছে সাধারণ (আম) এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ হচ্ছে বিশেষ (খাস্‌)। সুতরাং আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া
তা’আলা) সাধারণ নির্দে শের পর বিশেষ নির্দে শ কেন দিলেন? আলেমদের মতে, একটি আম এর পর যদি একটি খাস্‌ থাকে এবং একে অপরের
সাথে সংযুক্ত থাকে, সেক্ষেত্রে খাস্‌ বিষয়টি অতিরিক্ত অর্থ বহন করে। যেমন- আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা.) বলেন- "যে ব্যক্তি আল্লাহ,
তাঁ র ফেরেশতা ও রাসূলগণ এবং জিবরাইল ও মিকাইলের শত্রু হয়, নিশ্চিতই আল্লাহ সেসব কাফেরদের শত্রু। (২:৯৮)।

এখানে আল্লাহ বলছেন যারা আল্লাহর রাসূল ও ফেরেশতাগণ এবং জিবরাইল ও মিকাইল এর শত্রু হয়, আল্লাহও তাদের শত্রু হন। এখানে জিবরাইল
ও মিকাইল ফেরেশতাদের মধ্য হতে হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বিশেষভাবে উল্লখে করা হয়েছে। এখানে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সেইসব
ইহুদিদের কথা বলছেন যারা নিজেদের নিরাপদ দাবি করে। কিন্তু জিবরাইল ও মিকাইলের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। এক্ষেত্রে আলেমগণ দুটি অর্থ
করেন- একটি হতে পারে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদাস্বরূপ জিবরাইল ও মিকাইল-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন অথবা এর কারণ হতে পারে যে
ইহুদিদের জিবরাইলের প্রতি ঘৃণা কারণ তারা মনে করত জিবারইল (আ:) ভু ল করে নবুয়্যত নিয়ে রাসূল (স.)-এর কাছে গমন করেছিলেন,
কোনো ইহুদির কাছে না গিয়ে। (আল্লাহ তাদের অভিশপ্ত করুক)। সুতরাং আমরা দেখলাম সাধারণ বিষয়ের পর বিশেষ বিষয় উল্লেখ থাকলে তার
অর্থও অতিরিক্ত হয়।

এখন আমরা মূল আয়াতে ফিরে যাই, যেখানে আল্লাহ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের কথা বলেছেন। যা অতিরিক্ত অর্থ বহন করে।

প্রথম অর্থ হতে পারে, ইসলামে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের গুরুত্ব তু লে ধরা কেননা আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আল
খায়র (ইসলাম) এর পর এর উল্লখে করেছেন যেমনিভাবে আগের উদাহরণে আমরা দেখেছি।

দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, 'আদেশ' ও 'নিষেধের' আরবি পারিভাষিক অর্থ যেমন-'লিসান আল আরব' (আরবি ভাষার অভিধান) এবং ক্লাসিক্যাল
আরবি ভাষার অভিধান (আল ফায়রুজ আবাদি আল-কামূস আল মুহিত-এ এবং ইবন মানজুর-এর লিসান আল-আরব-এ) এই দুই জায়গায় আমরা
দেখতে পাই, এখানে মানুষকে নির্দে শ দেয়া এবং আদেশ এবং নিষেধ করাকে (সিয়াসাহ বা রাজনীতি) বলা হয়েছে। সুতরাং মানুষকে কিছু করতে
বলা এবং কিছু থেকে বিরত থাকেত বলা হচ্ছে রাজনীতি। তাই আল্লাহ যখন বলেন- 'ইয়াদ’উনা ইলাল খাইর ওয়া ইয়া‘মুরূনা বিল মারূফে ওয়া
ইয়ানহাওনা আনিল মুনকার' তখন আল্লাহ আমাদেরকে রাজনৈতিক উপায়ে ইসলামের আহবান করার কথা বলছেন। এবং এটাই হচ্ছে অতিরিক্ত
অর্থ যা তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন। এটাই হল একমাত্র পথ যার মাধ্যমে ইসলামের দিকে আহবান
করা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ কী? আমরা ইসলামের দিকে আহবান করতে পারি রাজনৈতিকভাবে অথবা অরাজনৈতিক
ভাবে। যেমন- আমরা মানুষকে বলতে পারি- 'ভাই, 'সালাত' আদায় করুন কারণ এটি একটি ফরয ইবাদত ইত্যাদি। অথবা কাউকে মিথ্যে বলতে
দেখলে বলত পারি 'ভাই মিথ্যে বলা হারাম'। যেমননিভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন- " যখন কেউ মিথ্যে কথা বলে, তখন ফেরেশতারা ব্যক্তিটি
থেকে নির্গত হওয়া দুর্গন্ধের কারণে অনেক দূরে সরে যায়" [আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত]। অর্থাৎ আপনি কোনো ব্যক্তিকে হারাম
করতে দেখলে নিষেধ করুন এবং ফরয ত্বরক করলে আদায়ের নির্দে শ দেন, কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র এবং শাসকদের ব্যাপারে আপনার দায়িত্ব কী?
আমরা যখন সৌদি-আরবের বাদশাহদেরকে হারামের মধ্যে নিয়োজিত দেখি তখন নিশ্চু প থাকি। অথচ উম্মাহ্‌র সাধারণ মানুষেরা হারাম করলে
নিষেধ করি। এক্ষেত্রে আপনি ইসলামের দিকে আহবান করছেন এটা কেউই অস্বীকার করবে না কিন্তু আপনি রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন না।
এর অর্থ হচ্ছে, আপনি সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে কথা বলছেন অথচ শাসকবর্গকে ছেড়ে দিচ্ছেন। এভাবে সমাজ পরিবর্ত ন সম্ভব নয়। আর এটা
সমস্যার সমাধানও নয়।

আল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন- "আমি যদি জানি যে আল্লাহ আমার একটিমাত্র দাওয়াহ্‌কবুল করবেন। তবে আমি দাওয়াহ্‌করব। আমি
দাওয়াহ্‌ করব না কোনো মুজাহিদদেরকে যারা জিহাদ করছে, কাফিরদের কাছে ইসলাম পৌঁছে দিচ্ছে এবং মুসলিম উম্মাহ্‌কে রক্ষা করছে, না
কোনো গরিব মানুষদেরকে, না কোনো মাকে, না কোনো শিশুকে না কোনো অসুস্থকে বরং শুধুমাত্র শাসকবর্গকে (দাওয়াহ্‌ করব)।" শাসক যদি
সৎ হয়, আল্লাহর ইচ্ছায় তার মানুষগুলোও হবে সৎ। যেমন: উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময়।

একবার এক ব্যক্তি আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)- এর কাছে এসে বললেন, "এটা কেন যে, আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-এর খিলাফত
আমল ছিল অনেক বেশি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ? তখন আলি (রা.) বললেন- 'কারণ ওনাদের সময় আমার মতো মান্যকারীরা ছিল আর আজ আমার
সাথে আছে তোমাদের মতো মান্যকারীরা।" এরপরও আলি (রা.) মানুষের দেখাশোনা করেছেন এবং রাষ্ট্রের বিদ্রোহীদের শাস্তি দিয়েছেন। আর
এটাই হল রাজনৈতিক পন্থা এবং এই অতিরিক্ত অর্থের কথাই বলা হয়েছে।

"ওয়া উলা ইকা হুমুল মুফলিহুন"- অর্থ: 'তারাই হবে সফলকাম।' 'তারা' বলতে উম্মাহ্‌কে বুঝানো হয়েছে এবং 'ফালাহ্‌' বলতে বোঝানো
হয়েছে দুনিয়া ও আখিরাত। অর্থাৎ, তাদের দুনিয়ার জীবন হবে সুন্দর এবং আল্লাহ আখিরাতে তাদেরকে পুরস্কৃ ত করবেন ও জান্নাতে দাখিল
করবেন।

এই হুকুমটি সাধারণভাবে ফরযে কিফায়া। ইমাম ইবনে কাসির, ইমাম আল কুরতু বী, ইমাম আল গাজ্জালি তাঁ র বই 'আল মুসতাসফা'-তে, ইমাম
ইবনে হাযম তাঁ র বই 'আল ইহকাম ফি উসুল আল আহকাম'-এ এবং ইমাম জারীর আত্‌তাবারি প্রত্যেকেই এই বিষয়টি ইজতিহাদ করেছেন এবং
বলেছেন এটি উম্মাহ্‌র জন্য 'ফরযে কিফায়া' এবং সমষ্টিগতভাবে এটি আদায় করা উচিত। তখন এই ফরযটিকে আমরা কীভাবে বুঝব? প্রথম
'নির্দে শনাটি' (কারীনা) ছিল 'ওয়াও' যদিও তা নিশ্চিত নয় তথাপি যে সকল আয়াতের সাথে এর সংযোগ ঘটেছে তা ফরযের দিকেই নির্দে শনা
প্রদান করে। আবার আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ইসলামের দিকে আহবান করতে বলেছেন যা একটি ফরয বিষয়। একই ভাবে আল্লাহ
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে বলেছেন এবং আমরা সকলেই জানি এটি ফরয। আল্লাহ বলেছেন- "আর ঈমানদার পুরুষ,
ইমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে নিষেধ করে।" [৯:৭১] আবার আল্লাহ
বলেছেন- "বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা কাফের তাদেরকে দাউদ ও মরিয়ম তনয় ইসার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে। এটা এ কারণে
যে, তারা অবাধ্যতা করত এবং সীমা লঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না, যা তারা করত, তা অবশ্যই মন্দ
ছিল।" অর্থাৎ পূর্ববর্তী কাফের সম্প্রদায়ের উপর অভিসম্পাত করা হয়েছিল তাদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ না করার কারণে।
আর যেহেতু মুসলমানদের জন্য ইহুদি অথবা খ্রিস্টানদের অনুসরণ হারাম তাই এটি ফরয বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-" তোমরা সৎকাজের আদেশ কর এবং অসৎকাজের নিষেধ কর। নতু বা আল্লাহ তোমাদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তিকে
ক্ষমতায় চাপিয়ে দিবেন। যারা তোমাদের উপর জঘন্যসব শাস্তি চাপিয়ে দিবে, এরপর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ লোকেরা দোয়া করবে কিন্তু সে
দোয়ার উত্তর দেয়া হবে না।"

"তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কর নতু বা আল্লাহ তোমাদের বিপরীতে এমন কাউকে দাঁ ড় করাবেন যাদের অন্তরে থাকবে না
তরুনদের জন্য কোনো দয়া এবং বৃদ্ধদের জন্য কোনো শ্রদ্ধা।" [ইবনুল কাইয়্যুম]

তাই যেহেতু সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা ফরয এবং উক্ত আয়াতে দলটির এই কাজকে সরাসরি সংযুক্ত করা হয়েছে সুতরাং
এই দলটি থাকাও ফরয হয়ে গিয়েছে।

সর্বশেষ নির্দে শনাটি (কারীনাহ) এই আয়াতে উল্লখে করা হয়েছে তা হলো- এই কাজটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে 'মুফলিহুন' অর্থাৎ সফলতার
সাথে অর্থাৎ যারা কাজটি আদায় করবে তারাই সফল অন্যরা নয়। এইসকল কারীনাহ আয়াতটির ফরয হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। এছাড়াও
সাধারণভাবে একটি উসুল (নীতি) আমরা সবাই জানি যে, 'যা কিছু ফরযের দিকে নিয়ে যায় তা নিজেই ফরয।' [মা লা ইয়াতিম্মুল ওয়াজিবু ইলা
বিহী ফা-হুয়া ওয়াজিব]।

বর্ত মানে এই উম্মাহ্‌র অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় যে মুনকার (অসৎকাজ) সাধিত হচ্ছে তা হল মুসলিম শাসকগুলো কুফর আইন দ্বারা শাসন করছে।
কুফর ও পুঁজিবাদের প্রচার-প্রসারই হচ্ছে সবচেয়ে বড় 'মুনকার' (অসৎকাজ) আর তাই সবচেয়ে বড় মা’রূফ (সৎকাজ) হচ্ছে ইসলামকে সকল
দ্বীন/জীবন ব্যবস্থার উপর বিজয়ী করা, পৃথিবীর বুক থেকে কুফরকে সরিয়ে ইসলাম বাস্তবায়ন করা, কাফেরদের কাছে ইসলামকে পৌঁছে দেয়া। হয়
তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা জিজিয়া দিয়ে ইসলামি শাসনের ছায়াতলে আসবে। এই সর্বোচ্চ পর্যায়ের মা’রূফটি আমরা কীভাবে আদায় করব?
এটা ততক্ষণ আদায় হবে না যতক্ষণ না আমরা একটি ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামকে সমাজে বাস্তবায়িত না করছি। সুতরাং ইসলামি
খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় যদি না আমাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল থাকে, যারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে যায়।
সুতরাং এই সব নির্দে শনাই ফরযের দিকে ইঙ্গিত করে। এবং এটি একটি সমষ্টিগত ফরয। কেননা বলা হয়েছে-' তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি
দল হোক'।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে ইসলামে একের অধিক দল থাকা কি জায়েজ? একাধিক দল থাকা বা দুটি দল থাকা কি হারাম? ইত্যাদি।

এই আয়াতে আল্লাহ যদি একটি দল থাকা নির্দি ষ্ট করে দিতেন তাহলে 'উম্মাহ' শব্দটির পর 'ওয়াহিদা' শব্দটিও উল্লেখ থাকত যার অর্থ 'এক'।
উসূলের পরিভাষায় একে 'আল মাফহুম' বলে এবং এটি 'আল মাফহুম আল-আদাদ' শ্রেনিতে পড়ে। সুতরাং উক্ত আয়াতে একটি দলের কথা
নির্দি ষ্ট করে দেয়া হয় নি বরং সাধারণভাবে 'উম্মাহ্‌' বলা হয়েছে তাই একাধিক দল থাকা জায়েজ। এবং এটি একটি সমষ্টিগত ফরয ইবাদত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমষ্টিগত ইবাদত (ফরয কিফায়া) এবং ব্যক্তিগত ইবাদত (ফরযে আইন)-এর মধ্যে পার্থক্য কী? নিচের উদ্ধৃ তিটি ইমাম আল
গাজ্জালির বই 'আল মুসতাসফা' থেকে। যেখানে তিনি বলেছেন- "ব্যক্তিগত ইবাদত ও সমষ্টিগত ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এটি কীভাবে
আদায় করা হয় তার ভিত্তিতে এবং কীভাবে গুনাহের দায়ভার সরানো হবে তার ভিত্তিতে। উভয়ে শর’ঈ অর্থের দিক থেকে সকল মুসলিমের জন্য
ফরয, কিফায়া হোক বা আইন হোক। যদিও ব্যক্তিগত ইবাদত প্রত্যেক মুসলমানে উপর ফরয আর সমষ্টিগত ইবাদত মুসলমানদের মধ্যে একটি
দলের উপর ফরয। কিন্তু এই পার্থক্যটি শুধুমাত্র 'হুকুমি' পার্থক্য। সুতরাং ব্যক্তিগত ইবাদত প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয এবং তা আদায় করলে
গুনাহ্‌থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু কিছু ব্যক্তি যদি তা আদায় না করে তবে গুনাহর দায়ভার এড়াতে পারবে না। যেমন: 'সালাহ'। অন্যদিকে সমষ্টিগত
ইবাদতও প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কিন্তু কিছু ব্যক্তি যদি তা আদায় করে তবে তারা যেমনি গুনাহ থেকে মুক্তি পাবে এবং পুরস্কৃ ত হবে
তেমনিভাবে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্‌ই ফরয আদায়ের দায়ভার হতে মুক্তি পাবে।

এখন 'ফরয কিফায়া' সংক্রান্ত বিষয়ে ভু ল বুঝাবুঝি হতে পারে। অনেক মুসলিমই বলে থাকেন, যেহেতু এটি ফরযে কিফায়া, তাই তু মি যাও আদায়
কর এবং আমি আমার কাজ করি। 'ফরয কিফায়া' একটি ফরয। পার্থক্যটি শুধু 'হুকুমি'।

তাই প্রত্যেক মুসলমানের এই ফরয দায়িত্বে অংশগ্রহণ করা আবশ্যক। যেমনিভাবে আবশ্যক খিলাফত (ইসলামি রাষ্ট্র) ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায়
অংশগ্রহণ নতু বা এই গুনাহের দায়ভার থেকেই যায় যেমনি করে দায়ভার থেকে যায় 'সালাত' আদায়ের ক্ষেত্রে যতক্ষণ না তা আদায় করা হচ্ছে।
আর তাই সমগ্র উম্মাহ্‌র উপর খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ফরয যতক্ষণ র্পযন্ত না তা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আর তা না করলে সমগ্র উম্মাহ্‌ই গুনাহগার
হবে শুধুমাত্র তারা ছাড়া যারা খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অন্য সকল সমষ্টিগত ফরযের জন্য যেমন জানাজা, মৃতের গোসল
জিহাদ ইত্যাদি সকল ফরযের ক্ষেত্রে একই 'হুকুম' প্রযোজ্য হবে।

বর্ত মানে মুসলমানরা 'ফরয' শব্দটি এড়িয়ে সরাসরি 'কিফায়া' শব্দটি বেছে নেয়। আমাদের বুঝতে হবে ফরয হচ্ছে তাই যা আদায় করলে পুরস্কৃ ত
হবে আর আদায় না করলে গুনাহগার হবে। তবে কেউ আদায় করে ফেললে আমার কাঁ ধ থেকে গুনাহের ভার নেমে যাবে। এই বিষয়টি ঠিক
একইভাবে বর্ণিত হয়েছে ইবনে বাদরানের বইতে এবং ইবনে কুদামাহ আল মাকদিসির বই 'রাওয়াদাত আল নাযির ওয়া সুন্নাত আল-মুনাযিরে।'
আমাদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই মনে রাখতে হবে।

এভাবেই আমাদের আয়াত থেকে আহ্‌কাম বের করতে জানতে হবে এবং আহকাম সম্বন্ধে জ্ঞান রাখতে হবে যেন আমরা 'মুকাল্লদি মুত্তাবি' হতে
পারি। মুকাল্লদি আম্মী (দলীল না বুঝেই অনুসারী) নয়। মুকাল্লদি আম্মী কোনো হুকুম সম্বন্ধে দলীল না জেনেই অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ,
একজন মুকাল্লদি আম্মী কোনো বিষয়ের হালাল অথবা হারাম সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে, কিন্তু সে জানতে চায় না হুকুমটির পক্ষে দলীলটি কী
অথবা হুকুমটি বের করার ক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে কিনা। আমাদেরকে তাদের মত নয় বরং এক ধাপ এগিয়ে ‘মুকাল্লদি মুত্তাব’
হতে হবে। আমাদেরকে দলীল জানতে হবে এবং হুকুম বের করার ক্ষেত্রে দলীলসমূহের বিস্তারিত জানতে হবে। ইনশাআল্লাহ, আমরা শুধু এখানেই
থেমে যাব না; আমরা মুজতাহিদ হওয়ার চেষ্টা করব এবং সকল দলীল ও হুকুম জানার চেষ্টা করব। আর তাহলেই আমরা নিজেরাই কুরআন ও
সুন্নাহর দলীল থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসতে পারব।

You might also like